ইসমাইল আলী: উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এজন্য প্রতি বছর বড় অঙ্কের লোকসান গুনছে সংস্থাটি। এ ঘাটতি পূরণে গত অর্থবছর থেকে ভর্তুকি দিচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। চলতি অর্থবছর সংশোধিত বাজেটে এ খাতে প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। যদিও বাজেটে এ বিষয়ে কিছুই উল্লেখ নেই।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে জনপ্রশাসন, কৃষি, প্রতিরক্ষা, জনশৃঙ্খলা ও সামাজিক নিরাপত্তা এবং কল্যাণ খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩০ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। তবে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি এবং প্রণোদনা বাবদ বরাদ্দ শূন্য দেখানো হয়েছে।
তথ্যমতে, উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনে কম মূল্যে বিক্রি করায় ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৫৭ হাজার ৯১৩ কোটি টাকার বেশি লোকসান গুনেছে পিডিবি। অর্থবছর শেষে তা ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এজন্য গত কয়েক বছর ধরে ভর্তুকি চাইলেও তা ঋণ হিসেবে দেওয়া হতো পিডিবিকে। তবে প্রতি বছরই ভর্তুকির পরিবর্তে ঋণ দিয়ে আসছিল অর্থ মন্ত্রণালয়।
এদিকে ২০১৬ সালের নভেম্বরে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির শুনানি শেষে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) পিডিবির ঘাটতিকে ভর্তুকি হিসেবে প্রদানে অর্থ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়। এর ভিত্তিতে গত অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি চায় পিডিবি। অর্থ মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফা চিঠিও দেয় সংস্থাটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত অর্থবছরে প্রথম দফা পিডিবিকে ৯৫৬ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়।
চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত আরও সাত হাজার ৫৬ কোটি টাকা ভর্তুকি পায় সংস্থাটি। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত আরও দেড় হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি ছাড় করতে গত মাসে চিঠি
দিয়েছে পিডিবি, যা জুনের আগেই ছাড় হয়ে যাবে। ফলে চলতি অর্থবছর সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি পাচ্ছে বিদ্যুৎ খাতে। তবে বাজেটে এ বিষয়ে কোনো তথ্যই উল্লেখ নেই।
জানতে চাইলে পিডিবির মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) মো. কাওসার আমীর আলী শেয়ার বিজকে বলেন, পিডিবির ঘাটতি মেটাতে গত অর্থবছরে প্রথম ভর্তুকি ছাড় করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করা হয়েছে। তারা পিডিবির সব হিসাব যাচাই-বাছাইপূর্বক সন্তুষ্ট হয়ে ভর্তুকি প্রদানে সম্মত হয়েছে। চলতি অর্থবছরও এ প্রক্রিয়া চালু আছে।
তিনি বলেন, বাজেটে ভর্তুকি খাতে কত বরাদ্দ প্রয়োজন হবে, সে হিসাব পৃথকভাবে নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সে অনুযায়ীই অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে বাজেটে এ বিষয়ে পৃথক বরাদ্দ রাখা হয়নি কেনÑতা বলতে পারব না।
উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরের জন্য বিদ্যুৎ খাতে সংশোধিত বরাদ্দ রয়েছে ২৪ হাজার ১১২ কোটি টাকা। এর মধ্যে উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ ২৪ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা এবং অনুন্নয়ন ব্যয় ৩৬ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের জন্য সংশোধিত বাজেট যাচাই-বাছাই করে দেখা যায়, ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৮ হাজার ৩০১ কোটি, কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য আট হাজার ৭০ কোটি, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে তিন হাজার ৩৫০ কোটি, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিভাগের জন্য ৮০৮ কোটি এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৪৪৪ কোটি টাকা। এর বাইরে রফতানি ভর্তুকি খাতে চার হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি অর্থবছর পিডিবির লোকসান দাঁড়াবে ১০ হাজার ২৭১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। বিদ্যুৎ খাতে এর পুরোটাই ভর্তুকি হিসেবে দেবে অর্থ মন্ত্রণালয়। এক্ষেত্রে মে ও জুন মাসের হিসাব চূড়ান্ত করে আগামী অর্থবছরে চিঠি দেওয়া হবে।
পিডিবির তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পিডিবির লোকসান দাঁড়ায় ৯ হাজার ২৮৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা। সংস্থাটির ইতিহাসে এটি ছিল সর্বোচ্চ লোকসান। এর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চার হাজার ৪৩৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছিল সংস্থাটি। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে লোকসান ছিল তিন হাজার ৮৭৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সাত হাজার ২৮২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এছাড়া ২০১৩-১৪ অর্থবছরে পিডিবি লোকসান গোনে ছয় হাজার ৮০৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছরে পাঁচ হাজার ৪৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছরে ছয় হাজার ৬৯৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা এবং ২০১০-১১ অর্থবছরে চার হাজার ৬২০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
লোকসানের ঘাটতি পূরণে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে ৫০ হাজার ৭৪০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ঋণ সহায়তা নিয়েছিল পিডিবি। এর মধ্যে তিন শতাংশ সুদে বাজেটরি সহায়তা বাবদ দেওয়া হয়েছে ৪৩ হাজার ১৬০ কোটি ১২ লাখ টাকা। আর বিনা সুদে সরকারি ঋণ ছিল সাত হাজার ৫৮০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এতে পিডিবির ব্যালেন্স শিটের অবস্থা খুবই করুণ হয়ে পড়েছে।
বিপুল এ আর্থিক চাপ সামাল দিতে প্রদত্ত পুরো ঋণ মওকুফের আবেদন করে পিডিবি। এ ঋণ মওকুফের প্রক্রিয়াও চলছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এজন্য পিডিবির সব আর্থিক হিসাব যাচাই-বাছাই করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এক্ষেত্রে করণীয় নির্ধারণে একাধিক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। শিগগিরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে। তবে আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে এ-বিষয়ক কোনো তথ্যও উল্লেখ নেই।
