এনামুল হক নাবিদ, আনোয়ারা (চট্টগ্রাম): রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) জিম্মি হয়ে পড়ছে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট চক্রের কাছে। রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠানটিতে দীর্ঘদিন ধরে লুটপাটের মহোৎসব করছে চক্রটি। এর মধ্যে সারাদেশে সারের জন্য হাহাকার চললেও বছরে গড়ে চার মাস বন্ধে থাকে এ কারখানা। রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির যেন শেষ নেই। এস্টেট শাখা, জ্বালানি তেল, নিয়োগ বাণিজ্য, ভুয়া বিলসহ এ প্রতিষ্ঠানে চলছে দুর্নীতির সুনামি। এছাড় যন্ত্রপাতি কেনাকেটার নামে গত দুই তিন বছরে সিইউএফএল চলছে হরিলুট। এর পেছনে রয়েছে কারখানায় কর্মরত কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কিছু সিবিএ নেতা।
এর মধ্যে গত এক বছরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সিইউএফএলের বেশ কয়েকটি দুর্নীতির খবর সারাদেশে আলোচনার জš§ দিয়েছে। তার মধ্যে নাস্তার কোটি টাকার বিল, বাসা বরাদ্দে ঘুষ বাণিজ্য, কারখানা বন্ধে এমডি সিন্ডিকেট (সাবেক এমডি আব্দুর রহিম ও আখতারুজ্জামান), তেলে তেলেসমাতি, ভুয়া বিলসহ আরও বেশ কিছু খবর। এবার অনুসন্ধানে দেখা যায়, সিইউএফএলে যন্ত্রাংশ কেনার নামে শত কোটি টাকার অনিয়ম।
জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে কারখানাটি ওভারহলিং হয়। যার বাজেট ছিল ২৫ কোটি টাকা। তবে এ অর্থবছরে কারখানাটি ওভারহলিং এ ব্যয় হয় প্রায় ১৭ কোটি টাকা। সারকারখানা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এরকম একবার কারখানা ওভারহলিং হলে অন্তত পরবর্তী ৭ থেকে ৮ বছরে কোটি টাকার আর কোনো মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করতে হয় না। তবে দেখা যায়, ২১ অর্থবছরে ওভারহলিং হওয়া সত্ত্বেও ২০২২-২৩ অর্থবছরের ভেতরেই আন্তর্জাতিক পদ্ধতি বাদ দিয়ে ডিপিএম পদ্ধতিতে প্রায় ৫ কোটি টাকা কারখানার মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যয় দেখানো হয়। এছাড়া ডিপিএম পদ্ধতিতে আরও কোটি কোটি টাকা কারখানার অ্যামোনিয়া, ইউরিয়া ও ইউটিলিটি প্লান্টের বিভিন্ন প্রেশার রেটিংয়ের বিভিন্ন সাইজের পাইপ বেসেল ক্রয়ের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানা যায়।
এদিকে কারখানা বন্ধ ও যান্ত্রিক ত্রুটির অজুহাতে বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্র (বিটাক) এর নাম ব্যবহার করে লিবার্টি নামের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মূলত মেরামতের নামে লুটপাট হচ্ছে শত শত কোটি টাকা। দেখা যায়, প্রতিবার বছরে দুই থেকে তিনবার যান্ত্রিক ত্রুটির নামে কারখানাটি বন্ধ করা হয়। তার অজুহাতে ক্রয় করা হয় শত শত কোটি টাকার যত্রাংশ। মেরামতের নামে যন্ত্রাংশ কেনাকাটার বিষয়টি অনুসন্ধান করলে বেরিয়ে আসে সিইউএফএলের লুটপাটের নেপথ্যে নায়কদের চেহারা। তার মধ্যে রয়েছে এমটিএস বিভাগের প্ল্যান মেন্টেন্যান্স প্রধান হিসেবে বর্তমানে কর্মরত সৌমিত্র সাহা (ডিসিই), যার সহযোগী হিসেবে রয়েছে নির্বাহী প্রকৌশলী বিশ্বজিত বড়ুয়া, সহকারী প্রকৌশলী জাফরুল্লাহ ব্যাগিং শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল জলিল, মেশনারি শাখার আব্দুল লতিফ ও সাইফুল ইসলাম।
কারখানার বেশ কয়েকটি টেন্ডার নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই সৌমিত্র সাহা সিন্ডিকেটই যন্ত্রণাংশ কেনাকাটা ও মেরামতের নামে লুটপাট করছে শত শত কোটি টাকা। দেখা যায়, বিসিআইসি পত্র নং ৩৬.০১.২৬৫৪.৩২১.০৭.০০২.২১.৫০০ এখানে চাহিদাকৃত ইন্টারনাল পার্টস সংগ্রহের নামে শত শত কোটি টাকা লোপাট করেছে এ সৌমিত্র সাহা। এছাড়া দেখা গেছে, ২০২১ অর্থবছরে ওভারহলিং রক্ষণাবেক্ষণ নামে টুলস ক্রয়ে হয়েছে নানা অনিয়ম। কারখানা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এখানে ওভারহলিং সময় যে টুলস ব্যবহার হয়েছে তা পুরোনো এবং কারখানার কাজে ব্যবহার হয়নি। যদি হয় তাদের মতে তাহলে ২২-২৩ অর্থবছরে ফের টুলস ক্রয় করা কেন হবে। সিইউএফএল সূত্রে জানা যায়, ২১ অর্থবছরের ওভারহলিং কাজের সদস্য সচিব ছিলেন পিঅ্যান্ডএস শাখার উপ-প্রকৌশলী এ সৌমিত্র সাহা। তৎকালীন সময়ের এমডি আখতারুজ্জামানের ছত্রছায়ায় এ সময় লোপাট হয়েছে কোটি কোটি টাকা। অনুসন্ধানে দেখা যায়, সিইউএফএল এ ইউরিয়া প্লান্টের কাজে হয়েছে বড় ধরনের অনিয়ম।
পাশাপাশি জেএফসিএল ও এএফসিসিএল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে টেলিফোনে এ ব্যাপারে আলাপ করা হলেও লিখিত কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি বলে বিটাকের মাধ্যমে এই সৌমিত্র সাহা মেসার্স বিটাক, ঢাকা/চট্টগ্রাম/চাঁদপুরকে পত্র দেয়া হলে শুধু মেসার্স বিটাক, চট্টগ্রাম একটি দরপত্র দাখিল করে বলে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। নির্মাণাধীন এ রকম বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা দিয়ে এই কাজ করা সম্ভব। তবে দেখা যায়, একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে এখানে বিল করা হয়েছে ৮৫ লাখ টাকা। এ বিষয়ে নির্মাণাধীন প্রতিষ্ঠান বিটাকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা এ বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি নয়।
নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তারা বলেন, সিইউএফএলের লুটপাটের চক্রের নায়ক এই সৌমিত্র সাহা ও তার সহযোগীরা। এই সৌমিত্র সাহা বিসিআইসির বিগত দুই এমডি (আব্দুর রহিম ও আখতারুজ্জামান), বিসিআইসির বেশ কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কয়েকজন সিবিএ নেতারে খোরাক জোগান দিয়ে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ডিপিএম পদ্ধতিতে টেন্ডারের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা লোপাট করে যাচ্ছে।
সিইউএফএলের এসব অনিয়মের বিষয়ে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি আখতার কবির চৌধুরী বলেন, রা®্র¡ের প্রতিটা সেক্টরে দুর্নীতি অনিয়মটা রীতিগত একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি আসলে আগামীর বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক একটি অশনিসংকেত।
এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে সিইউএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শহীদুল্লাহ খান বলেন, আমি সদ্য যোগদান করলাম। বিষয়গুলো তো আমার জানা নেই। তবে এসব বিষয় গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা হবে এবং কারখানার স্বার্থে কোনো অসাধু কর্মকর্তাদের ছাড় দেয়া হবে না। এছাড়া কারখানা অস্থিতিশীল করতে চাইলে কোনো শ্রমিক ও কর্মকর্তা বিসিআইসি নির্দেশনা অমান্য করলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।