মো. সুলাইমান; ব্যাপক সমালোচিত সিকদার গ্রুপকে জামানত ছাড়াই ১ হাজার ৩৫ কোটি টাকার ঋণ দিয়ে বিপাকে পড়েছে শরিয়াহভিত্তিক ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি। এসব ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা যাচাই-বাছাই, বিনিয়োগ পরিশোধ সক্ষমতা যাচাই, সম্ভাব্য আয়-ব্যয় ও ঝুঁকি বিশ্লেষণ করা হয়নি। ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ এক প্রতিবেদনে চাঞ্চল্যকর এ অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। জানা গেছে, বেসরকারি খাতের এ ব্যাংটির দিলকুশা, কারওয়ান বাজার, ধানমন্ডি, বনানী ও সেনানিবাস শাখা থেকে শিকদার গ্রুপকে এসব ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। আর ঋণের পুরো অংশই ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যাংক গ্যারান্টি ইস্যু করার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সহযোগী জামানত গ্রহণ করা হয়নি। খুবই নগণ্য নগদ মার্জিন নিয়েই ব্যাংক গ্যারান্টি ইস্যু করা হয়েছে। এছাড়া শাখা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সরেজমিন বন্ধকি সম্পত্তি পরিদর্শন ও মূল্যয়ন করা হয়নি।
গ্রুপটিকে ব্যাংকটির দেয়া ১ হাজার ২৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকার ফান্ডেড লোনের বিপরীতে ১৪৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা জামানত রয়েছে। অন্যদিকে ১৬৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা নন-ফান্ডেড লোনে (ব্যাংক গ্যারান্টি) নগদ জামানত রয়েছে ৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
আলোচ্য এই সময়ের মধ্যে সিকদার গ্রুপের কাছ থেকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক আদায় করেছে ৫৭৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। মুনাফাসহ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মোট দায় ২ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। ব্যাংকটির নথির তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকটিতে শিকদার গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ১৩ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চেয়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মো. ওয়াসেক আলীকে মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেয়া হয়ে। তবে তিনি কল রিসিভ করেননি। এছাড়া হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
ব্যাংকটির দিলকুশা শাখা জয়নুল হক শিকদার ও মেসার্স আর অ্যান্ড আর হোল্ডিংসকে ১০৩ কোটি ৪ লাখ টাকা বিতরণ করেছে। আর এই ঋণের বিপরীতে মাত্র ৫৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকার জামানত রাখা হয়েছে। ব্যাংকটির পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শাখাটিতে ঋণের মধ্যে এখন বকেয়া ২২৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
কাওরান বাজার শাখা কোনো জামানত ছাড়াই সিকদার গ্রুপের দুটি কোম্পানি বেঙ্গল ও অ্যান্ড সার্ভিসেস এবং এস. কিউ. ট্রেডিং অ্যান্ড ডেভেলপারকে ২৬০ কোটি ২৭ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। কারওয়ান বাজার শাখায় এখন ৪৩৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে।
ধানমন্ডি শাখা জামানত ছাড়াই ১৭৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা বিতরণ করেছে, যার মধ্যে বকেয়ার পরিমাণ ২৩৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। বনানী শাখা সিকদার গ্রুপকে জামানত হিসাবে ১১ কোটি ১১ লাখ টাকার বিপরীতে ১৫০ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। এ শাখায় সিকদার গ্রুপের বকেয়ার পরিমাণ ২৪৮ কোটি ৭৩ কোটি টাকা। এ শাখা মাত্র ৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকার মার্জিনের বিপরীতে গ্রুপকে ১৫৩ কোটি ৮০ লাখ টাকার নয়টি ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়েছে।
অপরদিকে সেনানিবাস শাখা সিকদার গ্রুপের ছয়টি কোম্পানিকে ৮৩ কোটি ১৯ লাখ টাকার জামানতের বিপরীতে ৩৩৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা বিতরণ করেছে। এ শাখায় গ্রুপটির বকেয়ার পরিমাণ ১ হাজার ৯৯ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এছাড়া শাখাটি সিকদার গ্রুপের দুটি কোম্পানিকে ১৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকার পাঁচটি ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়েছে, যেখানে মার্জিন হিসাবে মাত্র ১ কোটি টাকা। একইসঙ্গে নন-ফান্ডেড লোন সুবিধার বিপরীতে অন্য কোনো জামানত নেয়া হয়নি।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক খাত সংস্কারে গঠিত টাস্কফোর্সের সদস্য ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, এত বড় জামানতবিহীন ঋণ ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রশ্রয় ছাড়া সম্ভব হয়নি। দেখেও না দেখার ভান ধরা হয়েছে। এসব কাজে প্রভাবশালীরা জড়িত ছিল, তারা আবার পালিয়েও গেছে। তবে এখনও তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভাব চালিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তার মাধ্যমে এসব কাজ হয়েছে তার সবাই দোষী না। কারণ তারা চাকরি করতে গিয়ে ওপর মহলের নির্দেশ মেনেছে। রাঘববোয়ালদের ধরতে না পারলে পুঁটি মাছের পেছনে দৌড়ালে ভালো ফল আসবে না। এক্ষেত্রে শাস্তি দেয়া অর্থ হলো, পরবর্তীতে যেন আর কোনো অনিয়ম না হয়। তবে বড় অনিয়মকারীদের ধরতে ছোটদের কাজে লাগানো যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ছোট কর্মকর্তাদের ভয়ের জায়গাগুলোর নিশ্চয়তা দিতে হবে। বিশেষ করে তাদের জীবিকার যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেটার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
এদিকে পরিদর্শন প্রতিবেদনে আরও দেখা গেছে, ঋণগ্রহীতার ঋণ বা বিনিয়োগ অ্যাকাউন্ট সঠিকভাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়নি। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশিকা অনুসারে ক্রেডিট তথ্য ব্যুরোতে রিপোর্ট করেনি। এছাড়া সার্ভেয়ারের মাধ্যমে মূল্যায়িত জমির মূল্যমান, বন্ধকিতব্য জমির লোকেশন ও চৌহদ্দি, বন্ধকি সম্পত্তিতে সহজ গমনাগমন, বিক্রয় যোগ্যতা যাচাই-বাছাই করা হয়নি।