দেড় বছর আগে কক্সবাজারের মাতারবাড়ী থেকে সমুদ্র তলদেশ দিয়ে চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) পর্যন্ত জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য আট হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং বা এসপিএম প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। পাইপলাইনও কমিশনিং হয়েছে। তবে গত ছয় মাসেও অপারেটর নিয়োগ না হওয়ায় প্রকল্পটি চালু করা যাচ্ছে না। এতে প্রকল্পটি উদ্বোধনের পরও দেড় বছর ধরে অলস হয়ে পড়ে আছে। ফলে সনাতন প্রক্রিয়ায় তেল খালাসে ব্যয় হচ্ছে টাকা।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, সমুদ্র তলদেশ দিয়ে জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য ২০১৫ সালে ‘ইনস্টলেশন অব এসপিএম উইথ ডাবল পাইপ লাইন’ শীর্ষক প্রকল্পটির মূল ও সংশোধিত উন্নয়ন প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করা হয়। প্রকল্পটির শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৪ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে আরও তিন দফা বাড়িয়ে সংশোধিত ব্যয় ৮ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। জিওবি ও বিপিসির অর্থায়নে প্রকল্পটিতে ঋণ দেয় চায়না এক্সিম ব্যাংক। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কাজ করে চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (সিপিপিইসি)। প্রকল্পটিতে ২২০ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে অফশোর পাইপলাইন ১৩৫ কিলোমিটার, এইচডি ক্রসিংয়ের অফশোর অংশ ১১ কিলোমিটার এবং মোট অনশোর পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় ৭৪ কিলোমিটার। এছাড়া সমুদ্র থেকে মহেশখালী ট্যাংক টার্মিনাল পর্যন্ত ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ দুটি পাইপলাইন এবং মহেশখালী থেকে ইস্টার্ন রিফাইনারি অংশে সাগরের তলদেশে ১৮ ইঞ্চি ব্যাসের ৯৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে দুটি পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল এবং অন্যটিতে ডিজেল পরিবহনের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া গভীর সমুদ্রে একটি ভাসমান মুরিং পয়েন্ট এবং মহেশখালীতে একটি স্টোরেজ ট্যাংক টার্মিনালও নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্পটির কক্সবাজার অংশে মহেশখালীতে প্রায় ৮৯ একর জমিতে তিনটি ক্রুড অয়েল ট্যাংক (প্রতিটি ৫০ হাজার ঘনমিটার), ৯০ হাজার টনের তিনটি ডিজেল ট্যাংকসহ (প্রতিটি ৩০ হাজার ঘনমিটার) স্কাডা, প্রধান পাম্প, বুস্টার পাম্প, জেনারেটর, মিটারিং স্টেশন, পেগিং স্টেশনসহ অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করা
হয়েছে। কিন্তু অপারেটর নিয়োগ না হওয়ায় পেট্রোলিয়াম ট্রান্সমিশন কোম্পানি এসপিএম পরিচালনা করছে।
বিপিসির পরিকল্পনা বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, বড় তেলবাহী জাহাজ থেকে ছোট আকারের জাহাজে করে জ্বালানি তেল খালাস করা হয়। এতে সময় ও ব্যয় দুটোই অনেক বেশি। এ তেল খালাস ও পরিবহনের সময় কমিয়ে আনার জন্য প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে গত বছরের শুরুর দিকে কক্সবাজারের মাতারবাড়ী অংশ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে ডিজেলসহ বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেল পরিবহন শুরু করা হয়। শুরুতে কিছু জটিলতা দেখা দিলেও পরে জ্বালানি তেল পরিবহনে পরীক্ষা সফল হয়। তখন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডকে (সিপিপিইসি) অপারেটর নিয়োগের মাধ্যমে চালু করার কথা ছিল। কিন্তু সরকার পরিবর্তনে বদলে যায় অপারেটর নিয়োগ প্রক্রিয়া। ২০২৪ সালের ২১ নভেম্বর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা পরিষদের কমিটির (এসিসিইএ) সভায় চায়না কোম্পানির সঙ্গে অপারেটর নিয়োগের চুক্তি স্বাক্ষরের অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু গত ২ জানুয়ারি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক সভায় সেই অনুমোদন বাতিল করে উš§ুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে অপারেটর নিয়োগ করে প্রকল্প পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। এ প্রক্রিয়া শেষ হলে চালু হবে এসপিএম।
জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসপিএম প্রকল্পটির অপারেশন শুরু না হওয়ায় এখনও লাইটারিং করে তেল খালাস হচ্ছে। এতে রাষ্ট্রের বছরে ৮০০ কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে। তেল পরিবহনে সময়ও বেশি লাগছে। যদি নির্মাণকাজ চলাকালেই অপারেটর নিয়োগসহ ব্যবস্থাপনা কাঠামো গঠনের উদ্যোগ নেয়া হতো, তাহলে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার পরপর জ্বালানি তেল পরিবহন শুরু করা সম্ভব ছিল। কিন্তু অপারেটর নিয়োগ ও উš§ুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রকল্পটি চালু হবে না। আবার পাইপলাইনে ৫০ শতাংশ সক্ষমতা অব্যবহƒত থাকবে। এটিতে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের অদক্ষতা ও দূরদর্শিতার অভাব ছিল।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) প্রকৌশলী মো. আমীর মাসুদ শেয়ার বিজকে বলেন, এসপিএম প্রকল্প ২০২৪ সালে শেষ হয়। এটি একটি বিশেষায়িত কাজ হওয়ায় অধিক সংখ্যক দরদাতা প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ নিশ্চিতে প্রকল্পে ঠিকাদার নিয়োগে জিটুজি (সরাসরি) ক্রয়ের পরিবর্তে পিপিএ ও পিপিআরের আওতায় প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতিতে ক্রয় কার্য সম্পন্নকরণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। পিপিআর কর্তৃপক্ষে নির্দেশনায় দরপত্র আহ্বানে কাজ চলছে। আশা করছি এ মাসে দরপত্র আহ্বান করা হবে। আগামী তিন বছরের জন্য অপারেটর নিয়োগ করা হবে। আর অপারেটর নিয়োগ হলে এসপিএম চালু হবে। তখন প্রকল্পের সুফল পাওয়া যাবে।