মেহেদী হাসান, রাজশাহী : বছর দুয়েক আগে করোনার পরিস্থিতিতে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় রাজশাহীর বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ডিমের দামে ধস নেমে প্রতিটি ডিমে তিন থেকে চার টাকা লোকসান দিয়েছিলেন খামারিরা। সেসময় লেয়ার লাল মুরগির এক হালি (চারটি) ডিম ২৪ থেকে ২৫ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। এখন নেই করোনা, নেই নিষেধাজ্ঞা, কিন্তু আছে অদৃশ্য সিন্ডিকেট। গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ডিমের দাম নেমেছে আট টাকায়। অথচ একটা ডিম উৎপাদনে খরচ পড়ছে ৯ টাকা ৯১ পয়সা। সে হিসেবে বর্তমানে খামারিরা প্রতিটি ডিমে দুই টাকা লোকসান গুনছেন।
বাংলাদেশে পোলট্রি খামারি রক্ষা পরিষদ (বিপিকেআরজেপি), বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাট্র্জি সেন্ট্রাল কাউন্সিল ও পোলট্রি প্রফেশনালস বাংলাদেশ (পিপিবি) একটি ডিম কিংবা এক কেজি ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ কত তা জানিয়েছে। সেসব হিসাবের সঙ্গে খামারিদের হিসাব কিছুতেই মিলছে না। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাবে বর্তমানে খামারি পর্যায়ের প্রতিটি ডিমের উৎপাদন খরচ ৯.৫০- ৯.৭৫/৯.৯১ টাকা। সেইসঙ্গে প্রতি কেজি ব্রয়লার মাংসের উৎপাদন খরচ হচ্ছে ১৪০-১৪৫ টাকা। অথচ ২০২১ সালে একটা বাদামি ডিম উৎপাদনে খরচ হয়েছে সাত টাকা ২৬ পয়সা এবং সাদা ডিমে ৬ টাকা ৩০ পয়সা। অন্যদিকে ব্রয়লার এক কেজিতে খরচ ছিল ৯৯ টাকা ১৬ পয়সা। মাত্র বছরের ব্যবধানে ২০২২ সালে এসে একটা বাদামি ডিম উৎপাদনে খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ টাকা ৭৩ পয়সা এবং সাদা ৯ টাকা ৪০ পয়সা। প্রতিকেজি ব্রয়লারের উৎপাদন খরচ বেড়ে হয়েছে ১৪৫ টাকা ৬৫ পয়সা। খরচ বাড়লেও বাড়েনি ডিম-মুরগির দাম।
গত বুধবার বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল ও পোলট্রি প্রফেশনালস বাংলাদেশ (পিপিবি) প্রকাশিত প্রতিদিনের ডিম, মুরগি ও বাচ্চার দামে দেখা যায়, রাজশাহী অঞ্চলে পাইকারিতে খামারি পর্যায়ে প্রতিটি লাল ডিম বিক্রি হয়েছে আট টাকা ১০ পয়সায় ও সাদা ডিম ৭ টাকা ৭০ পয়সায়। অথচ এসব ডিম উৎপাদনে খরচ পড়েছে সাড়ে ৯ টাকার ওপরে। বাজারে ১৬৫ টাকা কেজিতে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হলেও খামার পর্যায়ে দাম ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা। ফলে খামারিরা মুরগিতে লোকসান গুনছেন ১০ থেকে ১৫ টাকা।
নগরীর সাহেব বাজার কলাপট্টির পাইকারি ডিম বিক্রেতা রেজাউল ইসলাম মিঠু বলেন, ‘ডিমের দাম একবারেই কমে গেছে। লস দিয়ে খামারিরা ডিম বিক্রি করছেন। ইচ্ছা হলেই তো আর মুরগি বিক্রি কিংবা ব্যবসা বাদ দেয়া যায় না। ডিম নিয়ে আতঙ্ক ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। ঈদের পর থেকে দাম বাড়তে বাড়তে একটু বেশি হয়েছিল। তাছাড়া অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। পাইকারিতে প্রতি ১০০ লাল ডিম ৮৫০ টাকা ও সাদা ৮০০ টাকা করে বিক্রি করছি। কিনেছি লাল ডিম ৮২০ টাকায় এবং সাদা ৭৭০ টাকায়। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজশাহীর সাহেব বাজার, নিউমার্কেট ও লক্ষ্মীপুর কাঁচাবাজার এলাকা ঘুরে বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা ডিম বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
স্বাভাবিক অবস্থায় লাল ডিম ৩৬ টাকা হালি এবং সাদা ৩৪ টাকা হালি বিক্রি হয়ে থাকে বলে জানান পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। ফলে আগের তুলনায় ডিমের এক হালিতেই নেই ১০ থেকে ১১ টাকা। এ অবস্থায় মাথায় হাত খামারিদের। সেইসঙ্গে ব্যবসা মন্দা হওয়া সত্ত্বেও আশার কথা বলছেন রাজশাহী পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন ও পাইকারি ডিম ক্রেতা বিক্রেতারা। তারা বলছেন, খুব শিগগিরই ডিমের দাম আবার বাড়বে।
হাঁস-মুরগির ডিম ব্যবসায়ী ও পাইকারি সরবরাহকারী আব্দুল জলিল মিয়া বলেন, ডিমের দাম বাড়াবেই। এভাবে চললে তো আর খামারিরা বাঁচবে না। প্রতি ডিমে ১০ টাকা খরচ করে বিক্রি করছেন ৮ টাকায়। লাল ডিম ৩৬ টাকা ও সাদা ডিম ৩৪ টাকা।
নগরীর চন্দ্রিমা থানা এলাকার লেয়ার মুরগির খামারি রুবেল হক বলেন, ডিমের দাম কমে যাওয়ায় লোকসান হচ্ছে। মুরগির খাবারের টাকাই জুটছে না। খাবারের সঙ্গে ওষুধ আছে। নানা খরচ করে ডিমের আবার দাম নেই। দাম না বাড়লে আমাদের বাঁচার উপায় নেই। খাবারের দাম বেড়েছে। সবকিছুর খরচ বেড়েছে। আমরা বাঁচব কীভাবে!
রাজশাহী পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক বলেন, ডিম কাঁচামালের মধ্যে পড়ার কারণে সঠিক বলা যাচ্ছে না। তবে ডিমের বাজারে এখন দাম কম। কিন্তু পোলট্রি খাদ্যের প্রধান উপাদান ভুট্টার দাম বেড়েছে। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ৩৭ শতাংশ বেড়ে ২৪ টাকার ভুট্টা এখন ৩৩ টাকা।
এছাড়া সয়াবিন মিল ৩৭ টাকা থেকে ৭০ টাকায় দাঁড়িয়েছে, অর্থাৎ বেড়েছে ৮৮ শতাংশ। চালের কুঁড়া ২১ টাকা থেকে ৩৬ টাকা, যা শতাংশ হিসেবে বেড়েছে ৭৭। পোলট্রি মিল ৫৪ টাকা থেকে লাফিয়ে হয়েছে ৮০ টাকা, যা বেড়েছে ৮৪ শতাংশ। হিসাব অনুযায়ী ডিমের দাম সাড়ে ১০ টাকা করার দাবি জানিয়েছি।