সিপিডির গবেষণা প্রতিবেদন: ২০২৩ সালে দুই লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকার কর ফাঁকি

২০২৩ সালে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা কর ফাঁকি দেয়া হয়েছে। ওই বিপুল পরিমাণ ফাঁকি রোধ করতে পারলেও বড় অঙ্কের রাজস্ব আদায় সম্ভব হতো বলে মনে করছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।

‘করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স রিফর্ম ফর গ্র্যাজুয়েটিং বাংলাদেশ: দ্য জাস্টিস পার্সপেক্টিভ’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে গতকাল ধানমন্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এসব তথ্য তুলে ধরেন। ক্রিশ্চিয়ান এইড ইন বাংলাদেশ ও সিপিডি যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষক মো. তামিম আহমেদ।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমাদের গবেষণায় দেখতে পেয়েছি ২০২৩ সালে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা কর ফাঁকি হয়েছে। এনবিআর কী পরিমাণ প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করছে। শুধু যে কর ফাঁকি তা নয়, করজালের বাইরেও অনেক খাত ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের করজালের মধ্যে আনা যায়নি। এই বিপুল পরিমাণ ফাঁকি রোধ করতে পারলেও আমরা বড় পরিমাণ অর্থ বা রাজস্ব আদায় সম্ভব।

তিনি বলেন, ডিজিটালইজেশন কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা আমরা দেখতে পারছি। ব্যবসায়ী ও এনবিআরের স্বার্থে এটা করা জরুরি। অথচ এনবিআর ও ব্যবসায়ীদের এক ধরনের অনীহা রয়েছে। বাংলাদেশে যে কোনো লেনদেন একক ডিজিটাল সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে, যাতে করে যে কোনো লেনদেন ট্রেস ও ট্র্যাক করা যায়। সেটার আলোকে দাখিলকৃত রিটার্নকে ভেরিফাই করা যায়।

অন্যদিকে এনবিআরকে ৭১ হাজার কোটি টাকা শুধু এনবিআরে কর ব্যয় হিসাবে ব্যয় করতে হয়। ওই বিপুল পরিমাণ ব্যয়ের অ্যাসেসম্যান্ট করা হয় না। কর ব্যয়ের মধ্যে প্রণোদনা রয়েছে। এত এত প্রণোদনা কাকে দেওয়া হয়? আমি বলতে চাই বিনিয়োগের জন্য কোনো বিনিয়োগকারীকে প্রণোদনা দেয়া হয় না। আমরা মনে করি, অ্যাসেসমেন্টের ভিত্তিতে প্রণোদনা বৃহৎ অংশ তুলে নেয়া উচিত।

উচ্চ মাত্রার রাজস্ব আয়ের কোনো বিকল্প নেই বলে উল্লেখ করে মোয়াজ্জেম বলেন, সরকারে যে কোনো ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উচ্চ মাত্রার রাজস্ব আয়ের কোনো বিকল্প নেই। আগামী দিনে উচ্চমাত্রায় রাজস্ব না পেলে ভর্তুকি, দক্ষতা, রপ্তানির বহুধাকরণ কিংবা ক্যাপাসিটি বিল্ডিং কোনো কিছু সরকার বাড়তিভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবে না। সেই প্রেক্ষাপটে সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়া উচিত অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি। এর মধ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর হিসাবে করপোরেট কর ও মূসক সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই দুই খাত থেকে প্রায় ৬০ শতাংশ রাজস্ব আসে। এই কারণে কর ন্যায্যতার ভিত্তিতে ওই খাতের সংস্কার করা দরকার।

তিনি বলেন, বাজেট আসলে বিভিন্ন প্রেসার গ্রুপ করহার কমানোর জন্য সরকারের ওপর চাপ দিতে থাকে। এর ফলে কর নিয়ে সরকারের প্রকৃত লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়, পরিকল্পনা খোলস আকারে থেকে যায়, যা আসলে ভালো ফল নিয়ে আসে না। সে কারণে আমাদের পরিকল্পনা প্রত্যক্ষ কর হিসাবে করপোরেট কর ও ভ্যাটকে একটি কাঠামোর আলোকে বিবেচনা করা। কর ন্যায্যতাকে বিবেচনায় রাখতে। কর ন্যায্যতার ভেতরে কর হার, কর ভিত্তি, কর ব্যয়, কর ফাঁকি ও কর প্রশাসক-এই পাঁচটি বিষয় কর ন্যায্যতার অংশ।

উল্লেখ্য, সিপিডির ২০২৩ সালের এ-সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে ২০১০ সালে করের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা, ২০২১ সালে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৪ হাজার কোটি টাকা। ছায়া অর্থনীতিতে ৮৪ হাজার কোটি টাকা কর ক্ষতি হচ্ছে, যা জিডিপির প্রায় ৩০ শতাংশ। এই টাকা যদি পাওয়া যেত তাহলে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় তিনগুণ বৃদ্ধি করা যেত। অর্থাৎ কর নেট বৃদ্ধির প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত। বড় অংশই করের বাইরে থেকে যাচ্ছে। ফলে কর ক্ষতি দিন দিন বাড়ছে।
এক্ষেত্রে ১৪১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫২তম। কর ফাঁকি ও কর এড়ানোর মধ্যে একটি যোগসূত্র রয়েছে। কর এড়াতে গিয়েও কর ফাঁকি দিচ্ছে কোম্পানিগুলো। আর কর ফাঁকি ৮০ শতাংশ হয়, তার মানে ২ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার মতো রাজস্ব হারায় দেশ। আবার যদি কর ফাঁকি ৫০ শতাংশ ধরা হয়, তাহলে রাজস্ব হারায় ৪১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।