Print Date & Time : 7 July 2025 Monday 9:17 pm

সিসাদূষণ: কারণ ও প্রতিকার

. মতিউর রহমান: সিসাদূষণ একটি বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য উদ্বেগ, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে; বিশেষ করে নিন্ম ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয়। বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, যা কয়েক দশক ধরে সিসাদূষণের ক্ষতিকারক প্রভাব মোকাবিলা করছে। বিভিন্ন আকারে সিসার উপস্থিতি, যেমন সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারি, পেইন্ট ও দূষিত পানি, দেশের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্য, পরিবেশগত এবং আর্থ-সামাজিক প্রতিক্রিয়ার দিকে পরিচালিত করেছে।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সিসাদূষণের ফলে বাংলাদেশে প্রতি বছর হƒদরোগে আক্রান্ত হয়ে এক লাখ ৩৮ হাজারেরও বেশি মানুষ অকালে মারা যায়। একই কারণে দেশের শিশুদের আইকিউ কমছে, এতে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।

বিশ্বব্যাংকের একদল গবেষক ‘গ্লোবাল হেলথ বার্ডেন অ্যান্ড কস্ট অব লিড এক্সপোজার ইন চিলড্রেন অ্যান্ড অ্যাডাল্টস: এ হেলথ ইমপ্যাক্ট অ্যান্ড ইকোনমিক মডেলিং অ্যানালাইসিস’ নামে এই গবেষণা করেছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিসাদূষণের কারণে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের চতুর্থ ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। ফলে একদিকে যেমন প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে হƒদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে, তেমনি শিশুদের আইকিউও কমছে। এর আর্থিক ক্ষতি প্রায় ২৮ হাজার ৬৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০১৯ সালে দেশের মোট জিডিপির প্রায় ছয় থেকে ৯ শতাংশের সমান।

সিসা শিশুদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। অতিরিক্ত সিসা শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশে বাধা দেয়। বাংলাদেশে ২০১৯ সালের তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখেছেন সিসাদূষণের কারণে দেশে শূন্য থেকে চার বছর বয়সী শিশুরা প্রায় দুই মিলিয়ন আইকিউ পয়েন্ট হারিয়েছে।

শিশুদের বুদ্ধিমত্তার সঠিক বিকাশ হয় না। ফলে তাদের নতুন জিনিস শিখতে যেমন সমস্যা হয়, তেমনি আচরণগত অসংগতিও দেখা দেয়। এ ছাড়া খাবারের প্রতি অরুচি, ওজন কমে যাওয়া এবং খিটখিটে মেজাজও নানা সমস্যা তৈরি করছে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের শিশুদের রক্তে উচ্চ মাত্রার সিসার উপস্থিতি তাদের প্রতিভার পরিপূর্ণ বিকাশে একটি বড় বাধা। এছাড়া সিসাদূষণের কারণে তাদের আইকিউ কমে যাচ্ছে, যা দেশের সার্বিক উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাই সিসাদূষণ বন্ধে জাতীয় পর্যায়ে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।’

সিসার বিষক্রিয়া একটি নীরব ও অবিরাম হুমকি, যা প্রায়ই গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা না হওয়া পর্যন্ত অলক্ষিত থাকে, যা এটিকে বিশেষভাবে বিপজ্জনক করে তোলে তা হলো এর ক্রমবর্ধমান প্রভাব। এমনকি ছোট, আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ সিসাদূষণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গুরুতর স্বাস্থ্য পরিণতি ঘটাতে পারে।

বাংলাদেশে শিশুরা বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, শিশুদের জন্য সিসার দূষণের কোনো নিরাপদ স্তর নেই। এমনকি কম মাত্রার সিসাদূষণও শিশুর জ্ঞানীয় বিকাশকে ব্যাহত করতে পারে, যার ফলে শেখার অক্ষমতা, আইকিউ হ্রাস ও আচরণগত সমস্যা হতে পারে। গর্ভাবস্থায় সিসার সংস্পর্শে অকাল জš§ ও শিশুর বিকাশে বিলম্ব হতে পারে।

বাংলাদেশে শিশুদের জন্য সিসাদূষণের একটি প্রধান কারণ হলো সিসাদূষিত ধুলাবালি ও মাটি। শহরাঞ্চলের অনেক বাড়িই সিসাভিত্তিক পেইন্ট দিয়ে আঁকা হয়, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খারাপ হয়ে যায়, পরিবেশে সিসার কণা ছড়িয়ে দেয়। যে শিশুরা মাটিতে খেলে বা দূষিত বস্তু নাড়াচাড়া করে, তারা অজান্তে সিসার ধূলিকণা গ্রহণ করে বা শ্বাস নেয়, যা দীর্ঘস্থায়ী দূষণের দিকে পরিচালিত করে।

সিসাদূষণে বাংলাদেশের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদানকারী হলো সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারির ব্যাপক ব্যবহার। এই ব্যাটারিগুলো যানবাহন, সৌরশক্তি সিস্টেম, বাড়ি ও ব্যবসার জন্য ব্যাকআপ পাওয়ার উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যদিও সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারি আধুনিক জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য, সেগুলোর অনুপযুক্ত ধ্বংস প্রক্রিয়া এবং পুনর্ব্যবহার গুরুতর স্বাস্থ্য পরিণতির দিকে চালিত করে।

ব্যবহƒত লিড-অ্যাসিড ব্যাটারিগুলো প্রায়ই দায়িত্বের সঙ্গে ধ্বংস বা পুনর্ব্যবহার করা হয় না। পরিবর্তে সেগুলো অনানুষ্ঠানিক পুনর্ব্যবহারযোগ্য হিসেবে মেরামত করা হয়, যেখানে কর্মীরা পর্যাপ্ত সুরক্ষা ছাড়াই ব্যাটারি থেকে সিসা বের করে। এই প্রক্রিয়াটি তাদের বিষাক্ত সিসার ধোঁয়া ও উপকরণের কাছে নিয়ে আসে, যার ফলে এই দুর্বল শ্রমিকদের মধ্যে গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়।

অধিকন্তু, যখন লিড-অ্যাসিড ব্যাটারিগুলো অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে দেয়া হয়, তখন তারা পরিবেশে সিসা ছেড়ে দেয়, মাটি ও পানির উৎসকে দূষিত করে। বৃষ্টির পানি এই দূষকগুলোকে নদী ও ভূগর্ভস্থ পানিতে বয়ে নিয়ে যেতে পারে, যা বাংলাদেশের শহর ও গ্রামীণ উভয় অঞ্চলকে প্রভাবিত করে।

যদিও লিড-অ্যাসিড ব্যাটারিগুলো সিসাদূষণে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখে, তবে সিসাদূষিত পানীয় জলে আরেকটি লুকানো হুমকি রয়েছে। বাংলাদেশের কিছু এলাকায়, নদীর গভীরতা নির্ণয় ব্যবস্থায় এবং পানি সরবরাহ পরিকাঠামোয় সিসার পাইপ ব্যবহার করা হয়। এই সিস্টেমগুলোর মধ্য দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি সিসাকণা সংগ্রহ করতে পারে, পানি সরবরাহকে দূষিত করে।

সিসাদূষিত পানি খাওয়া জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে। পানীয় জলের মাধ্যমে সিসার দীর্ঘায়িত দূষণের ফলে কিডনির ক্ষতি, উচ্চ রক্তচাপ, স্নায়বিক সমস্যাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। গর্ভবতী মহিলা ও ছোট শিশুরা বিশেষত পানিতে সিসার ক্ষতিকারক প্রভাবের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

শিল্পবর্জ্য নির্গমন বাংলাদেশে সিসাদূষণের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ, যা প্রাথমিকভাবে শিল্পকারখানা ও উৎপাদন কারখানার উচ্চ ঘনত্বসহ শহরাঞ্চলকে প্রভাবিত করে। এই শিল্পবর্জ্য নির্গমনগুলোয় সিসাকণা থাকে, যা মাটি, ভবন ও গাছপালাগুলোয় দানা বাঁধতে পারে, যা পরিবেশ দূষণে আরও অবদান রাখে।

শিল্পকারখানার শ্রমিকরা সিসাদূষণের উচ্চ ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া তারা তাদের পোশাক ও জুতাগুলোয় বিষাক্ত ধাতু বাড়িতে বহন করতে পারে, অসাবধানতাবশত তাদের পরিবারের মাঝে তা ছড়িয়ে যেতে পারে। তদুপরি শিল্পকারখানার কাছাকাছি বসবাসকারী লোকজন সিসাদূষণের বেশি ঝুঁকিতে থাকে, কারণ বিষাক্ত কণাগুলো বায়ু ও পানি দ্বারা বাহিত হতে পারে, যা আশেপাশের পরিবেশকে প্রভাবিত করে।

বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্যের ওপর সিসাদূষণের পরিণতি গভীরভাবে উদ্বেগজনক। যদিও সিসা বিষক্রিয়ার প্রভাবগুলো তাৎক্ষণিক এবং দৃশ্যমান লক্ষণগুলো প্রকাশিত নাও হতে পারে, তবে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ধ্বংসাত্মক হিসেবে স্বীকৃত।

সিসাদূষণ কার্ডিওভাসকুলার রোগ, কিডনির ক্ষতি এবং প্রজনন সমস্যাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে যুক্ত। সিসার সংস্পর্শে থাকা গর্ভবতী মহিলারা গর্ভপাত, মৃত সন্তান প্রসব বা সময়ের আগে প্রসবের সম্মুখীন হতে পারে। তাছাড়া, সিসার বিষক্রিয়া প্রাপ্তবয়স্কদের উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

বাংলাদেশে সিসাদূষণের বোঝা ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের বাইরেও প্রসারিত। এর গভীর আর্থ-সামাজিক পরিণতিও রয়েছে। সিসার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের বিশেষ শিক্ষা এবং সহায়তা পরিষেবার প্রয়োজন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, যা বিদ্যমান পরিষেবা কাঠামোর উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। সিসাদূষণের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যের প্রভাবগুলো একজন ব্যক্তির উচ্চশিক্ষা অর্জনের এবং অর্থপূর্ণ কর্মসংস্থান লাভের ক্ষমতাকে সীমিত করতে পারে, দারিদ্র্যের চক্রকে স্থায়ী করে।

অধিকন্তু, সিসাদূষণ বিদেশি বিনিয়োগ ও পর্যটনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে, কারণ পরিবেশ দূষণ ও জনস্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ বিশ্বমঞ্চে একটি দেশের সুনাম নষ্ট করতে পারে। পরিবেশগত সমস্যা সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান সচেতন বিশ্বে সিসাদূষণকে মোকাবিলা করা কেবল একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতায় নয়, বরং একটি অর্থনৈতিকও বিষয়ও বটে।

বাংলাদেশে সিসাদূষণ মোকাবিলায় শিক্ষা, জনসচেতনতা ও অবকাঠামো উন্নয়নকে অন্তর্ভুক্ত করে বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন। সিসাদূষণের বিপদ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা গুরুত্বপূর্ণ। বাবা-মা, সম্প্রদায় ও কর্মীদের সিসার সঙ্গে সম্পর্কিত ঝুঁকি এবং নিজেদের ও তাদের পরিবারকে রক্ষা করার জন্য তারা কী পদক্ষেপ নিতে পারে, তা বুঝতে হবে।

নিরাপদ ও সিসামুক্ত পানীয় জলের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। সিসাদূষণ শনাক্ত ও মোকাবিলা করার জন্য নিয়মিত পানির গুণমান পরীক্ষা করা উচিত।

সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারি আনুষ্ঠানিক পুনর্ব্যবহারযোগ্য, নিরাপদ ও আরও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে প্রতিস্থাপন করা আবশ্যক। এর মধ্যে রয়েছে কর্মীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম সরবরাহ করা এবং দায়িত্বশীল পুনর্ব্যবহারযোগ্য অনুশীলনকে উৎসাহিত করা।

সিসা বিষক্রিয়া চিনতে ও চিকিৎসা করার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া উচিত। প্রাথমিক পদক্ষেপ ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা সিসাদূষণের কিছু ক্ষতিকর প্রভাবকে প্রশমিত করতে পারে। সিসাদূষিত মাটি ও পানির উৎসগুলো শনাক্তকরণ এবং প্রতিকারের ওপর মনোযোগ দেয়া উচিত, বিশেষ করে এমন এলাকায় যেখানে উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে।

পরিবেশে সিসাকণার নিঃসরণ কমিয়ে শিল্পবর্জ্য নির্গমন নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর প্রবিধান থাকা উচিত। উপরন্তু, শিল্প কারখানাগুলোকে অবশ্যই তাদের পরিবেশগত বর্জ্য কমানোর জন্য পরিষ্কার ও সবুজ প্রযুক্তি গ্রহণ করতে হবে।

সিসাদূষণ বাংলাদেশে একটি ক্রমবর্ধমান জনস্বাস্থ্য উদ্বেগ, যা লাখ লাখ বিশেষ করে শিশুদেরকে প্রভাবিত করে, যারা বিধ্বংসী পরিণতি বহন করে। এই সমস্যাটির সমাধানের জন্য সরকারি সংস্থা, বেসরকারি সংস্থা, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী, শিল্পকারখানার মালিক এবং জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

বাংলাদেশে সিসাভিত্তিক পণ্য নিয়ন্ত্রণ এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য অনুশীলনের উন্নতির জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। জনসচেতনতামূলক প্রচারণা, নিরাপদ পানীয় জলে প্রবেশাধিকার এবং কঠোর শিল্পবর্জ্য নির্গমন নিয়ন্ত্রণÑসবই একটি ব্যাপক সমাধানের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

বাংলাদেশকে অবশ্যই নাগরিকদের স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখতে সিসাদূষণের বিরুদ্ধে লড়াইকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সিসার বিষক্রিয়ার নীরব হুমকিকে অবশ্যই একটি দৃঢ় প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে, যা সব বাংলাদেশির জন্য একটি উজ্জ্বল ও স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে।

ড. মতিউর রহমান

গবেষক ও উন্নয়নকর্মী