Print Date & Time : 28 August 2025 Thursday 2:06 am

সিসিএ আইন সংশোধন নিয়ে টানাপোড়েন

নিজস্ব প্রতিবেদক : পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের অর্থ জমা রাখার যৌথ অ্যাকাউন্ট (সিসিএ) থেকে পাওয়া সুদ আয়ের ব্যবহার নিয়ে নতুন নির্দেশনা জারি করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। নতুন নিয়মে সিকিউরিটিজ হাউসগুলো আর এই অর্থ নিজেদের আয় হিসেবে দেখাতে পারবে না। বরং আয়ের ৭৫ শতাংশ পুঁজিবাজার বিষয়ে প্রশিক্ষণে ও বাকি ২৫ শতাংশ ইনভেস্টর প্রকেটশন ফান্ডে জমা দিতে হবে। এ নিয়ে শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক, সিকিউরিটিজ হাউসগুলো নির্দেশনার বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আগের নিয়ম বহাল রাখার দাবি জানিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের অর্থ সিকিউরিটিজ হাউস ও গ্রাহকের যৌথ ব্যবস্থাপনায় ব্যাংকে জমা রাখা হয়। সেই অর্থের বিপরীতে যে সুদ আয় সেটা সিকিউরিটিজ হাউসের আয় হিসেবেই দেখানো হয়। হাউসের ব্যয় মেটাতে ব্যবহƒত হয় সেই অর্থ। স্বাধীনতার পর আবার পথচলা শুরুর পর থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এ নিয়ম বিদ্যমান ছিল। ২০২০ সালে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) এ বিষয়ে নতুন নির্দেশনা দেয়। যেখানে বিনিয়োগকারীদের মুনাফার অর্থ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু ঋণাত্মক মূলধনসহ চলমান সংকটের কারণে সেই নির্দেশনা কার্যকর হয়নি। বিএসইসির সঙ্গে আলোচনা এ বিষয়ে আগের নির্দেশনা বহাল চেয়েছে সিকিউরিটিজ হাউসগুলো। সর্বশেষ পুনর্গঠিত বিএসইসির সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এমন অবস্থার মধ্যেই সিসিএ অ্যাকাউন্টের অর্থ নিয়ে আইন সংশোধনের মাধ্যমে নতুন নির্দেশনার ঘোষণা এলো। বিষয়টি নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও হাউসগুলোর মধ্যে নতুন করে টানাপড়েন তৈরি হয়েছে।

সূত্রগুলো জানিয়েছে, সিসিএর মুনাফার অর্থ ব্যয় বিষয়ে সংশোধিত ধারায় নতুন নির্দেশনা দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। সংস্থা নতুন খসড়ায় আয়ের অর্থ সিকিউরিটিজ হাউসগুলোর আয় হিসেবে দেখানোর পথ বন্ধ করে দিয়েছে। সেইসঙ্গে অর্থের ৭৫ শতাংশ ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি বা পুঁজিবাজার বিষয়ে প্রশিক্ষণে ব্যয় করার বাধ্যবাধকতা রাখা হচ্ছে। বাকি ২৫ শতাংশ অর্থ বিএসইসি নিয়ন্ত্রিত ইনভেস্টর প্রকেটশন ফান্ডে জমার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে। সংশোধনের পর সিসিএর আয়ের অর্থ সিকিউরিটিজ হাউস বা বিনিয়োগকারী কেউ পাবেন না। তবে পরোক্ষভাবে পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থেই এ অর্থ ব্যয়ের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে।

বিদ্যমান আইন সংশোধন পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বলে জানিয়েছে বিএসইসির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র। তবে বিতর্ক হতে পারে, এমন শঙ্কায় কেউ নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে চায়নি। সূত্রগুলোর দাবি, বিদ্যমান আইনে সিসিএ’র অর্থ সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীদের দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন সংকটের কারণে হাউসগুলো সেই নির্দেশনা মানতে পারছে। বিরূপ ব্যবসায়িক পরিস্থিতি ও ঋণাত্মক মূলধনের কারণে হাউসগুলো মুনাফার অর্থ আগের মতোই ‘সুদ আয়’ বা ‘অন্যান্য আয়’ হিসেবে দেখিয়ে ব্যবস্থাপনায় ব্যয় করতে চায়। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ বিবেচনায় সংশোধন করে নতুন নির্দেশনা রাখা হয়েছে।

এদিকে বিদ্যমান আইনের সিসিএর অর্থ-সংক্রান্ত ধারা সংশোধনের জন্য খসড়া তৈরির পর অংশীজনদের মতামত চেয়েছিল বিএসইসি। এ বিষয়ে মতামত দেয়ার জন্য পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের ১২ মে পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছিল। এরই মধ্যে মতামত জানিয়েছে সিকিউরিটিজ হাউসগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ)। এককভাবে প্রায় দুই শতাধিক সিকিউরিটিজ হাউসও এ বিষয়ে তাদের মত জানিয়েছে। যেখানে প্রায় সবাই সংশোধনীর বিপক্ষে মত দিয়েছেন। সেইসঙ্গে বাস্তবতা বিবচনায় নিয়ে সিসিএর মুনাফার অর্থ ‘অন্যান্য আয়’ হিসেবে রাখার পক্ষেও মত দিয়েছেন দায়িত্বশীলরা।

‘নতুন নির্দেশনা পরিবর্তনের জন্য আমরা বিএসইসিকে অনুরোধ জানিয়েছি’ বলে উল্লেখ করে প্রাইম ব্যাংক সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিএসইসির এই আইনটি ‘ত্রুটিপূর্ণ’। প্রথমত, আন্তর্জাতিক আর্থিক রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী সুদ আয়কে ‘অন্যান্য আয়’ হিসেবে ধরতে হয়। পৃথিবীর অন্য দেশেও এ আয়কে সুদ আয় হিসেবে দেখানো হয়। আমাদের দেশে সুদ আয় অ্যাকাউন্টে জমার আগেই উৎসে ১০ শতাংশ সরকারি কর কেটে নেয়া হয়। তাই আমরা বিষয়টি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছি।’

এদিকে সিসিএ-সংক্রান্ত আইন সংশোধন ইস্যুতে একমত নয় পুঁজিবাজারে সিসিএ’র অংশীজনদের সংগঠন ডিএসই ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ)। সিসিএ’র মুনাফার আয়কে সিকিউরিটিজ হাউসের আয় হিসেবে দেখানোর দাবিই করছে সংগঠনটি। সংগঠনটির দায়িত্বশীলরা বলছেন, ‘আইন সংশোধন হলে সংকটে থাকা সিকিউরিটিজ হাউসগুলো আরও বিপদে পড়বে। কারণ করোনা-পরবর্তী সময় থেকে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সিসিএ থেকে আয়ের অর্থ হাউসগুলোর ব্যবস্থাপনা ব্যয় মেটাতে ব্যয় করতে হচ্ছে।’

ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ লিমিটেডের পরিচালক ও ডিবিএ প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ডিএসইর পথচলা আবার শুরুর পর থেকেই সিসিএর সুদ আয়কে সিকিউরিটিজ হাউসগুলোর ‘সুদ আয়’ বা ‘অন্যান্য আয়’ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এ আয়ের বিপরীতে আইন মেনে আয়করও দিচ্ছে হাউসগুলো। ২০২০ সালে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা না করেই একতরফাভাবে এ অর্থ সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীদের দেয়ার বিষয়টি যুক্ত করা হয়। সেই সময় আমাদের নিজেদের মত প্রকাশের অধিকার দেয়া হয়নি। এর পর থেকে আমরা এ বিষয়ে বিএসইসির সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছি। সেখানে এ আয়কে হাউসের আয় হিসেবে দেখানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে নতুন করে আইন সংশোধনের ঘোষণা এলো। এবার যে নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে, তা সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত নয়। এতে সিকিউরিটিজ হাউসগুলো আরও সংকটে পড়বে।’