‘মোংলায় দুর্ঘটনার কবলে ফার্নেস অয়েলবাহী জাহাজ’ শিরোনামে গতকাল শেয়ার বিজে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনের ভাষ্য, মোংলা বন্দর চ্যানেলের ১৫ নম্বর বয়া এলাকায় দুর্ঘটনায় ফার্নেস অয়েলবাহী ‘এমটি মনোয়ারা’ নামে একটি জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শনিবার ‘রিক ওশান ওয়েভ’ নামে একটি ডুবন্ত জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা লেগে এ ঘটনা ঘটে। এতে তেলবাহী জাহাজের পানির ট্যাংক ছিদ্র হয়ে গেলেও তেলের ট্যাংকারগুলো সুরক্ষিত রয়েছে বলে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
সুন্দরবন এলাকায় তেলবাহী জাহাজডুবির খবর নতুন নয়। বরং এ সংখ্যা এত বেশি যে, মনে হবে তেলবাহী জাহাজই বেশি চলাচল করে। কেবল ফিটনেসবিহীন জলযান চলাচল করে, তাই বলা যাবে না। কেননা যেসব জাহাজ দুর্ঘটনায় পড়েছে, প্রায় সবগুলোরই ডুবন্ত জলযানের সঙ্গে ধাক্কা লেগে তলা ফেটে যায়। এর অর্থ অকুস্থলে ডুবন্ত জাহাজের অবস্থান চিহ্নিত করা ছিল না।
কেবল ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পূর্ব সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ ডুবে যাওয়ার পর জাহাজডুবি আলোচনায় আসে। ওই জাহাজ থেকে সাড়ে তিন লাখ লিটারের বেশি ফার্নেস তেল সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়ে। নদীর তীরের কাছাকাছি নোঙর করা ওই জাহাজকে পণ্যবাহী জাহাজ আরেকটি ধাক্কা দিলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। ওই সময় পরিবেশবিদরা বলেন, এত তেল পানিতে ভেসে থাকায় উপকূলীয় প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। সুন্দরবনের মতো শ্বাসমূলীয় বনের গাছপালা শ্বাসমূল দিয়ে শ্বাস নেয়। তেলের আস্তরণ জোয়ারের সময় মাটির ওপরে বিস্তৃত হয়ে গাছের শ্বাস-প্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত করবে। ফলে গাছ মারা যাবে। পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেবে এবং মাছসহ জলজ প্রাণীও অক্সিজেন সংকটে ভুগবে। সুন্দরবনসংলগ্ন ডলফিন অভয়াশ্রম মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়লে ডলফিনের বসতি সরে যেতে পারে বলেই আশঙ্কা তাদের। ওই জাহাজডুবির আগে সিমেন্টের কাঁচামালবাহী জাহাজ পশুর চ্যানেলে দুটি পণ্যবাহী জাহাজ ডুবে যায়।
সুন্দরবন ও তৎসংলগ্ন এলাকায় বারবার জাহাজডুবির পর ওই রুটে বাণিজ্যিক নৌযান চলাচল বন্ধের দাবি করেন বিশেষজ্ঞরা। ডুবে যাওয়া কার্গো-জাহাজে থাকা পণ্য পরিবেশের ক্ষতি করবে, আবার জাহাজটি উদ্ধার না করলে অন্য জাহাজও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এভাবে কয়লা ও তেলবাহী জাহাজ ডুবে যাওয়ায় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়, আশপাশের এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সুন্দরবন এমনিতেই নানা ঝুঁকিতে রয়েছে। সুন্দরবন এলাকায় লবণাক্ততা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী দুই দশক নাগাদ সুন্দরবন থেকে সুন্দরীসহ অনেক গাছ বিলীন হয়ে যেতে পারে। অন্তত ৪০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। সুন্দরবন থাকায় সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগে অনেক বড় ক্ষতি ও ধ্বংসলীলা থেকে রক্ষা পেয়েছে দেশ। এমন একটি বনকে রক্ষায় এখনই স্থায়ী পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে ফিটনেসবিহীন এক স্তরবিশিষ্ট বাণিজ্যিক নৌযান ও জাহাজ চলাচল বন্ধ করতে হবে। যেসব জাহাজ ডুবেছে, সেগুলো উদ্ধার হওয়া পর্যন্ত অবস্থানস্থল চিহ্নিত করে রাখতে হবে, যাতে অন্য জাহাজ ওই স্থান এড়িয়ে চলতে পারে।