সুন্দরবনে বাঘের মৃত্যু, প্রকৃত কারণ উদঘাটন হোক

 

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপক‚লীয় অঞ্চলকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করে আসছে সুন্দরবন। মাতৃস্নেহে আগলে রাখা এই সুন্দরবন আমাদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করে দেশের উপক‚লে বসবাসরত সাধারণ জনগণ আয়লা, সিডর, আম্ফানে বারংবার বিধ্বস্ত হয়েছে। বেঁচে থাকার তাগিদে বাধ্য হয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে পাড়ি দিতে হয়েছে অন্যত্র। তবে বার বার আঘাত হানা এসব প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসের তাণ্ডবলীলা ও গতিকে দুর্বল করে দিয়েছে পৃথিবীর একক ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন। এতে তুলনামূলক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হয়েছে এবং উপক‚লীয় এলাকা রক্ষা পেয়েছে। তবে প্রকৃতি ও প্রাণিকুলের ওপর মানুষের অমানবিক আচরণে আজ বিপর্যস্ত এই সুন্দরবন। বৃক্ষনিধন, বন্যপ্রাণী হত্যা, পাচারসহ নানা কারণে আজ বিপর্যয়ের মুখে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। এই সুন্দরবনে গরান, গোলপাতা, সুন্দরী, বাইনসহ নানা জাতের গাছপালা রয়েছে। এখানে বাঘ, হরিণ, কুমির, সাপসহ নানা প্রাণীর বিচরণও লক্ষ করা যায়। নদীতে শুশুক, ডলফিন, কুমিরের দেখা মেলে। তবে এই বনে এক অনন্য প্রজাতির প্রাণী হলো রয়েল বেঙ্গল টাইগার। যে প্রাণী মূলত এই সুন্দরবনকে টিকিয়ে রেখেছে। কিন্তু সাম্প্র্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি বাঘের অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ পূর্ব ও পশ্চিম এ দুই ভাগে বিভক্ত। এ দুই অংশে নানা কারণে বাঘের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি বাঘের মৃত্যু হচ্ছে পূর্ব সুন্দরবনে। আর এই সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। যার ফলে সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতি আজ হুমকির মুখে পড়ছে।

বন বিভাগের তথ্য মতে, ২০০১ সাল থেকে ২০২৪ সালের ১২ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত গত ২৩ বছরে সুন্দরবনে নানাভাবে ৪১টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগে ২৫টি এবং পশ্চিম বিভাগে ১৬টি। সবশেষ ১২ ফেব্রুয়ারি পূর্ব সুন্দরবনের আওতাধীন বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার কচিখালীর একটি খাল থেকে এক বাঘের মরদেহ উদ্ধার করে বন বিভাগ। আমরা প্রায়ই দেখি, বাঘ মৃত্যুর ঘটনায় কারণ হিসেবে বার্ধক্য উল্লেখ করা হয়। আর বাঘ লোকালয়ে প্রবেশ করলে জনগণ যদি পিটিয়ে মারে তাহলে সেটি প্রকাশ পায়। কিন্তু এর ভেতর দিয়েও নানাভাবে বাঘের মৃত্যু হয়ে থাকে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেসব কারণ আর জানা যায় না। বাঘ উদ্ধারের পর ময়নাতদন্ত করে বিভিন্ন নমুনা পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো হলেও সে প্রকৃত কারণ আর পরবর্তীতে প্রকাশ পায় না। দেখা যায়, বয়স্ক হয়ে বাঘের মৃত্যু হয়েছে বলে ফাইল জমা হয়ে থাকে। কিন্তু কথা হলো, ঝড়-জলোচ্ছ¡াস, অসুস্থতা, বার্ধক্যের কারণেই যদি বেশিরভাগ বাঘের মৃত্যু হয় তাহলে ২৩ বছরে যে ২০টি বাঘের চামড়া উদ্ধার করা হয়েছে তার প্রকৃত কারণ কী? আর যেসব চোরা শিকারি এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের কী শাস্তি দেয়া হলো? সত্য বলতে, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যত উদ্যোগ নেয়া হোক না কেন; যতদিন আমরা আমাদের অতিরিক্ত লোভকে সংবরণ করতে না পারব ততদিন কোনোভাবেই সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতি রক্ষা করতে পারব না।

সর্বশেষ ২০১৮ সালের জরিপে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা ১১৪টির কথা বলা হয়েছে। তবে জেলে, মৌয়ালদের তথ্য অনুযায়ী, সে সংখ্যা কিছুটা বেশি বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু কথা হলো, দিন দিন সুন্দরবনের পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে। অবৈধ হরিণ শিকার, বাঘের অস্বাভাবিক মৃত্যুতে সুন্দরবনের পরিবেশ আজ ধ্বংসের দারপ্রান্তে। তাই বাঘের মৃত্যুর কারণ শুধু বয়স বাড়ার কারণে না দিয়ে; ময়নাতদন্তে প্রকৃত কারণ উদঘাটন করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। চোরাশিকারিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বন্যপ্রাণী আইনের ৩৬ ধারায় বলা হয়েছে, বাঘ শিকারি বা হত্যাকারী জামিন-অযোগ্য হবেন এবং সর্বোচ্চ ৭ বছর সর্বনি¤œ ২ বছর কারাদণ্ড এবং জরিমানা এক লাখ থেকে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তাই এ আইনটিও অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। সুন্দরবনে বিষ নিয়ে মাছ মারার খালের পানি দূষিত হচ্ছে কি না সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে আর চোরাশিকারীদের ওপর নজরদারি ঠিকমতো না হলে, বাঘ মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা করছে অনেক পরিবেশকর্মী। পাশাপাশি সুন্দরবনে বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল বৃদ্ধি করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাঘ যাতে সুন্দরবন ছেড়ে লোকালয়ে বের হতে না পারে এ জন্য বনের সীমানা এলাকায় বন বিভাগের টহল বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। যদিও ইতোমধ্যে সুন্দরবনের বাঘ রক্ষায় সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তবুও বাঘ ও সুন্দরবন রক্ষায় আমাদের নিজেদের সচেতনতা এবং সংশ্লিষ্ট বন বিভাগের দায়িত্বশীল আচরণের বিকল্প নেই।

রিয়াদ হোসেন

শিক্ষার্থী, সরকারি বিএল কলেজ

খুলনা