সুবর্ণজয়ন্তীতে আমার স্বাধীনতা

কাজী সালমা সুলতানা: ২৮ মার্চ, ১৯৭১। এদিন সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ঢাকা শহরে কারফিউ শিথিল করা হয়। রাতে চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের জন্য আবার বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়। জীবননগরে মহড়ারত প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার লে. কর্নেল রেজাউল জলিলের কাছে নির্দেশ আসে যশোর সেনানিবাসে ফিরে যাওয়ার জন্য। সে অনুযায়ী লে. কর্নেল জলিল তার প্রথম বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন নিয়ে সব অস্ত্রসহ যশোর সেনানিবাসে চলে যান। প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের পরবর্তী ইতিহাস বড় করুণ।

দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের প্রধান মেজর এমএ ওসমান চৌধুরী দুপুর ১২টার মধ্যে সীমান্তের সব কোম্পানিকে চুয়াডাঙ্গার ইপিআর সদর দপ্তরে রিপোর্ট করতে বলেন। কুষ্টিয়া আক্রমণের পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি কোম্পানি ঝিনাইদহ পাঠিয়ে দেয়া হয়। কোম্পানিটি যশোর-ঝিনাইদহ সড়ক অবরোধ করে।

পাকিস্তানি নৌবাহিনী বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় গোলাবর্ষণ করে। নৌবন্দর এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি নৌসেনাদের নিরস্ত্র করে হত্যা করে।

ঢাকার ওপারে জিঞ্জিরা দখল নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিবিনিময় হয়। যশোর, দিনাজপুর ও কুষ্টিয়ায় দখল প্রতিষ্ঠা নিয়ে তীব্র সংঘর্ষ হয়। দেশের তিন-চতুর্থাংশ এলাকা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিয়ন্ত্রণে থাকে।

ময়মনসিংহ থেকে মেজর নূরুল ইসলাম ঢাকায় বেতারযোগে সংবাদ পাঠান সেখানে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি সৈনিকদের ওপর আক্রমণ করেছে। সংবাদ পেয়ে মেজর নূরুল ইসলামকে সাহায্য করার জন্য মেজর কেএম শফিউল্লাহ সৈন্য নিয়ে সেদিকে অগ্রসর হন।

২৮ মার্চ রবিবার সকাল থেকে রংপুরের বিভিন্ন এলাকার মানুষ সংগঠিত হতে থাকে। সময় যত এগিয়ে আসে উত্তাপ আর উত্তেজনা ততই বাড়তে থাকে। বেলা ১১টা বাজতে না বাজতেই সাজসাজ রব পড়ে যায় চারদিকে। জেলার মিঠাপুকুর, বলদীপুকুর, মানজাই, রানীপুকুর, তামপাট, পালিচড়া, বুড়িরহাট, গঙ্গাচড়া, শ্যামপুর, দমদমা, লালবাগ, গণেশপুর, দামোদরপুর, পাগলাপীর, সাহেবগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজারো মানুষ একত্র হতে থাকে। সবার হাতে ছিল লাঠিসোটা, তীর-ধনুক, বর্শা, বল্লম, দা ও কুড়াল।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং সে সময় রংপুর ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ২৯ ক্যাভেলরি রেজিমেন্টের মেজর নাসির উদ্দিন তার ‘যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা’ গ্রন্থে বলেন, এ সময় ক্যান্টনমেন্ট থেকে গোটা দশেক জিপ বেরিয়ে আসে এবং মিছিল লক্ষ্য করে শুরু হয় একটানা মেশিনগানের গুলিবর্ষণ। মাত্র ৫ মিনিটে চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে যায়। হাজারো লাশ পড়ে থাকে মাঠে। কিন্তু তখনও যারা বেঁচে ছিল আর্তনাদে গোটা এলাকার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠল। তার বর্ণনায় আরও বলা হয়েছে, সেদিন সন্ধ্যার আগেই নির্দেশমতো ৫০০ থেকে ৬০০ মৃতদেহ পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বাঁশের লাঠি আর তীর-ধনুক নিয়ে পাকিস্তানি হায়েনাদের আবাসস্থল ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের ঘটনা ইতিহাসে বিরল। এমনি এক ঘটনাই সেদিন ঘটিয়েছিলেন রংপুরের বীর জনতা। ২৮ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ তথা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে এটাই তাদের মুখোমুখি প্রথম যুদ্ধ।

তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও ‘যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা