কাজী সালমা সুলতানা: বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বিনাশ করতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একাত্তরের প্রায় সারা বছর ধরেই সমগ্র দেশজুড়ে নজিরবিহীন গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ সংগঠিত করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে গণহত্যার পরিসমাপ্তি ঘটে। এসব গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে বলা হলেও বাস্তবে এই সংখ্যা ৩০ লাখেরও বেশি। এখন পর্যন্ত দেশে পাঁচ হাজারের অধিক বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এক হাজার বধ্যভূমি চিহ্নিত হয়েছে। দেশের আনাচে-কানাচে রয়েছে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য বধ্যভূমি ও গণকবর। ১৯৭১ সালের ৭ অক্টোবর সূর্যমণি গণহত্যা সংঘটিত হয়।
পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার সূর্যমণি গণহত্যা দিবস আজ। ১৯৭১ সালের এই দিন ভোররাতে উপজেলার আঙ্গুলকাটা গ্রামের ২৫ হিন্দু বাঙালিকে এক দড়িতে বেঁধে স্থানীয় রাজাকার বাহিনী নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে।
১৯৭১ সালের ৬ অক্টোবর এই দিন ভোর রাতে মঠবাড়িয়ার হিন্দু অধ্যুষিত আঙ্গুলকাটা গ্রাম থেকে ৩৭ জন নিরাপরাধ হিন্দু বাঙালিকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর স্থানীয় রাজাকার বাহিনী। ওই রাতে ৫০-৬০ জনের স্থানীয়ভাবে সংগঠিত একটি রাজাকার বাহিনী গ্রামের হানা দিয়ে ব্যাপক ধরপাকড় ও লুটপাট চালায়। ৩৭ জন হিন্দু বাঙালিকে ঘুমন্ত অবস্থায় বাড়ি থেকে তুলে নেয়। তাদের মধ্যে ৭ জনকে রাতভর মঠবাড়িয়া থানায় আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। পরের দিন মোটা অংকের অর্থের বিনিময় সাতজনকে ছেড়ে দেয়া হয়। বাকি ৩০ জনকে মঠবাড়িয়া শহর হতে আড়াই কিলোমিটার দূরে সূর্যমণি বেড়িবাঁধের ওপর এক লাইনে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে।
এ সময় ভাগ্যক্রমে গুলি খেয়ে বেঁচে যায় পাঁচজন বেঁচে গেলে বাকি ২৫ জন ঘটনাস্থলেই সেদিন শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, সমর্থন ও মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দানের জন্য স্বাধীনতাবিরোধীরা তাদের ওপর এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়।
সেদিন যারা সূর্যমণিতে শহীত হয়েছিলেন তারা হলেনÑজিতেন্দ্র নাথ মিত্র, শৈলেন মিত্র, বিনোদ বিহারী, ফণীভূষণ মিত্র, ঝন্টু মিত্র, নগেন কিত্তুনীয়া, অমল মিত্র, সুধাংশ হালদার, মধুসূদন হালদার, প্রিয়নাথ হালদার, সীতানাথ হাওলাদার, অন্নদা হাওলাদার, অনীল হাওলাদার, হিমাংশু মাঝি, জিতেন মাঝি, সুধীর মাস্টার, অমলেন্দু হাওলাদার, অচীন মিত্র, অরুণ মিত্র, নিরোধ পাইক ও কমল মণ্ডল ঘটনাস্থলেই শহীদ হন।
প্রাণে বেঁচে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা সুনীল মিত্রের কথা থেকে জানা যায়, ওই রাতে তার বাবা ও ছোট ভাইকেসহ আমাকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তার বাবা ও ভাইকে থানায় আটক করে নির্যাতনের পর ছেড়ে দেয়া হলে তার ছোট ভাই অষ্টম শ্রেণির ছাত্র শৈলেন মিত্রকে স্বাধীনতাবিরোধীরা সূর্যমণিতে গুলি করে হত্যা করে।
২০০১ সালে সূর্যমণি গণহত্যার ঘটনায় বিচার দাবিতে সাতজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে একটি মামলা দায়ের করা হয়। ওই সময়ে সূর্যমণিতে রাজাকারদের গুলি খেয়ে বেঁচে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা জ্ঞানেন্দ্র মিত্র (৬২) বাদী হয়ে মঠবাড়িয়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি দায়ের করেন। আদালতের তৎকালীন বিচারিক হাকিম মো. কবির উদ্দিন প্রামাণিক মামলাটি গ্রহণ করে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৬ (৩) ধারায় তদন্ত পূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মঠবাড়িয়া থানার অফিসার ইনচার্জকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরে পুলিশ মামলাটি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারভুক্ত করতে সুপারিশ করে। এ কারণে মামলাটি ট্রাইব্যুনালে অন্তর্ভুক্ত হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চূড়ান্ত রায়ে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী জব্বার ইঞ্জিনিয়ারের আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়। তবে তিনি বর্তমানে পলাতক রয়েছেন।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা দেশজুড়ে যে গণহত্যা চালায়, তা ইতিহাসের নির্মম ঘটনা। সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন অসংখ্য নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকেও হার মানায়। আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা যাদের হারিয়েছি তাদের সবাইকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। তারাই অনুপ্রেরণা হয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পথ দেখাবে।
কৃতজ্ঞতা: ১৯৭১ গণহত্যা ও নির্যাতন আর্কাইভ ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ট্রাস্ট
গণমাধ্যমকর্মী
salma15august@gmail.com