Print Date & Time : 22 July 2025 Tuesday 5:05 am

সেইসব গল্প, এইসব কয়েন

জাহিরুল ইসলাম: ছোটবেলায় সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় যে পয়সা মা হাতে তুলে দিতেন, তা কখনও চার বা আট আনার বেশি হতো না। মনে পড়ে, সেই সময় পাঁচ, দশ, পঁচিশ ও পঞ্চাশ পয়সার ধাতব মুদ্রার প্রচলন ছিল বেশি। এক টাকার কয়েন এসেছে অনেক পরে। স্কুলে যাওয়ার সময় মা একটি পাঁচ ও দুটি দশ পয়সার কয়েনসমেত তিনটি ধাতব মুদ্রা হাতে তুলে দিতেন; ঘরে থাকলে পঁচিশ পয়সার কয়েনও দিতেন কখনও কখনও। এও মনে পড়ে, এই মাত্র পঁচিশ পয়সা দিয়ে পাওয়া যেত চকোলেট, আইসক্রিম, আচার, মুড়িমাখা, ভুট্টাভাজাসহ কত কী! দশ পয়সায়ও পাওয়া যেত আচার, চকোলেটের মতো মুখরোচক খাদ্য। স্কুলে যাওয়ার সময় হাতে পঁচিশ পয়সা না পেলে মন খারাপ হয়ে যেত। বেঁকে বসে গাল ফুলিয়ে মাকে কখনও বলতাম, আজ স্কুলে যাব না। মা তখন কোনোদিন বকুনি দিতেন; আর কোনো কোনোদিন বুঝিয়ে বলতেন, পড়ালেখা শিখলে কী উপকার। পড়ালেখা শিখে বড় হলে এরকম কত পয়সা আসবে হাতে! মনে পড়ে, তখন সঞ্চয়েরও শিক্ষা দিতেন মা। পাঁচ ও দশ পয়সার কয়েনসমেত কোনোদিন পঁচিশ পয়সা দিলে উপদেশ দিতেন সেখান থেকে কিছু বাঁচানোর; বাড়িতে থাকা মাটির ব্যাংকে সঞ্চয়ের জন্য। কোনোদিন যদি কিছু কম খরচ করে বাড়িতে ফিরে ব্যাংকে ফেলতে পারতাম, সেদিন মুখে ফুটত দিগি¦জয়ীর হাসি। আর কোনোদিন যদি পঞ্চাশ পয়সা হাতে পাওয়া যেত, সেদিন নিজেকে মনে হতো স্কুলের সবচেয়ে সুখী ছাত্র। নিজে খাওয়ার পাশাপাশি বন্ধুদের আচার, চকোলেট খাওয়ানোর মতো বিলাসিতাও করা যেত। বেশি দিন আগে নয়, গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষ এবং পরবর্তী দশকের শুরুর দিকের কথা বলছি। আমার স্কুলযাত্রাটা ছিল ওই সময়ে।

তখন মানুষের মধ্যে মাটির ব্যাংকে সঞ্চয়ের প্রবণতা ছিল। এ ধরনের ব্যাংক ছিল ঘরে ঘরে। প্রতিদিন বাজার থেকে যেসব ধাতব মুদ্রা ফিরত, সেগুলোই এতে জমিয়ে রাখতেন বাড়ির গৃহকর্ত্রীসহ অন্যরা। এটা কেনার সামর্থ্য যাদের ছিল না, তারা পয়সা জমাত ঘরের বাঁশের খুঁটির ছিদ্রে। মাটির ব্যাংকগুলো রাখা হতো দৃষ্টির আড়ালে। ধাতব মুদ্রায় ভরে যাওয়ার পর সেটা ভাঙা হতো। এ টাকা দিয়ে কেনা হতো শখের জিনিস। অর্থকরী জিনিসও কিনত কেউ কেউ। সেটা লাগানো হতো সংসারের কাজে। সেই সময় কলস মাটিতে পুঁতে টাকা জমানোর প্রবণতাও ছিল। এটা তারা করত, যাদের সামর্থ্য ছিল বেশি। কার বাড়ির কোথায় টাকার কলস লুকানো আছে, এ নিয়ে গল্প ফিরত মানুষের মুখে মুখে। অবশ্য এসবের সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের উপায় ছিল না। আর যাদের বাড়িতে এ ধরনের কলসে টাকা জমানো হতো, তারাও এটা করতেন খুব গোপনে; যাতে কেউ না জানে। তাতে ছিল টাকা চুরি যাওয়া কিংবা বাড়িতে ডাকাতির ভয়।

এ ধারায় সঞ্চয়ের প্রবণতা সম্ভবত শুরু হয়েছিল আরও আগে থেকে। মানুষ মাটির ব্যাংকে, কলস কিংবা বাঁশের খুঁটির ছিদ্রে ধাতব মুদ্রায় সঞ্চয় করত, কারণ তাতে টাকা পচে নষ্ট হতো না। সম্ভবত আরেকটি কারণে এটা করা হতো, ক্ষুদ্র সঞ্চয় যে সময়ের পরিক্রমায় একসময় অনেক বড় হয়ে ওঠে, সে সময় এ ব্যাপারে দৃঢ় ধারণা পোষণ করত মানুষ। এ শিক্ষা আমরা পেয়েছি স্কুল থেকেও। শিক্ষকরা প্রায়ই বলতেন, বিন্দু বিন্দু জলে গড়ে ওঠে সিন্ধু। পাঁচ-দশ পয়সা করে জমিয়ে যে অনেক টাকা সঞ্চয় সম্ভব, এ দিয়ে সম্ভব ভাগ্যের উন্নয়নÑসে রকম অনেক উদাহরণ শুনেছি তাদের মুখে।

সময় বদলেছে। মানুষ এখনও ক্ষুদ্র সঞ্চয় করে, তবে ভিন্ন উপায়ে। সঞ্চয়ের কিছু আধুনিক কৌশল পৌঁছেছে হাতে হাতে। এখন টাকা জমানো যায় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের হিসাবে। ব্যাংকের শাখা পৌঁছেছে গ্রামগঞ্জে। যেখানে শাখা পৌঁছেনি, সেখানে দেখা যায় ব্যাংকের পল্লি উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠকর্মীরা ছুটে যান মানুষের কাছে। সংগ্রহ করেন তাদের সঞ্চয়। বলা যায়, এতে ত্রিমাত্রিক উপকার পাচ্ছে মানুষ ও অর্থনীতি। প্রথমত, সঞ্চয়গুলো হচ্ছে নিরাপদ। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকের কাছে জমা থাকায় এ টাকা লাগানো যাচ্ছে উৎপাদনমূলক কাজে। তৃতীয়ত, মানুষ এগুলো ফেরত পাচ্ছে মুনাফাসহ। সঞ্চয়ের সনাতন পদ্ধতি থেকে তারা বের হতে না পারলে এসব উপকার পাওয়া যেত না।

বাস্তবতা হলো, এসব সুবিধা মানুষের হাতে কিংবা দোরগোড়ায় পৌঁছার ফলে ধাতব মুদ্রার চাহিদা কমে গেছে। আগে এ ধরনের মুদ্রাকে মানুষ যত আনন্দচিত্তে গ্রহণ করত, এখন তা করে না। বরং সিংহভাগ ক্ষেত্রে প্রকাশ করে বিরক্তি। এর পেছনে আরও যে কারণ রয়েছে, তা হলো এগুলোর সংরক্ষণ ও গণনার অসুবিধা। পাঁচ টাকার ধাতব মুদ্রার কিছুটা ব্যবহার হয়তো রয়েছে। তবে এর নিচের মানের এক ও দুই টাকার কয়েনের অস্তিত্বও এখন হুমকিতে। এক টাকার কাগুজে নোট এখন নেই বললেই চলে। দুই টাকার কয়েন গ্রাহকের হাতে তুলে দিলে দোকানিকে বরং শুনতে হয়, কাগুজে নোট নেই? এ ধরনের ধাতব মুদ্রার চেয়ে দোকানি চকোলেট বা চুইংগাম হাতে তুলে দিলেও খুশি থাকেন গ্রাহক। এমনটি কোনো কোনো সময় দেখা যায় ব্যাংকের কাউন্টারেও। ক্যাশ অফিসাররা যে কোনো মূল্যের ধাতব মুদ্রা দিতে চাইলে তা নিতে অনীহা প্রকাশ করেন গ্রাহক। ক্ষেত্রবিশেষে দাবি ছেড়ে দিয়েও চলে যান কেউ কেউ। এ থেকে বোঝা যায়, পরিস্থিতির কারণেই ধাতব মুদ্রা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে মানুষ। এগুলো আটকে যাচ্ছে ব্যবসায়ীর সিন্ধুক কিংবা ব্যাংকের ভল্টে। দিনের পর দিন পড়ে থাকছে স্ত‚পাকারে।

সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয়ের ভল্টে জমা রয়েছে ১ পয়সা মূল্যমানের ৩০ লাখ পিস ধাতব মুদ্রা, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৩০ হাজার টাকা। চার লাখ টাকা মূল্যমানের ৪০ লাখ পিস ১০ পয়সার ধাতব মুদ্রা জমা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। এছাড়া রয়েছে তিন লাখ ৭০ হাজার পিস ১০ পয়সা মূল্যমানের ধাতব মুদ্রা মতিঝিল কার্যালয়ের ভল্টে সংরক্ষিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সবচেয়ে বেশি ৫৪ লাখ পিস ধাতব মুদ্রা রয়েছে ২৫ পয়সার, যার বাজারমূল্য ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ৫০ পয়সার ১০ হাজার পিস ধাতব মুদ্রাও বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রয়েছে। ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে বাজারে ইস্যুকৃত এক টাকার ১৮৭ কোটি পিস, দুই টাকার ৭৮ কোটি ও পাঁচ টাকার ৪১ কোটি ৪০ লাখ পিস কয়েন রয়েছে। এর উল্লেখযোগ্য অংশ বিভিন্ন ব্যাংকের ভল্ট ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে জমা হয়ে আছে। [বণিক বার্তা, ১৬ অক্টোবর ২০১৭]

বস্তুত কোনো মুদ্রা বাজারে টিকে থাকে তার মূল্য নয়, এককভাবে ক্রয়ক্ষমতা দিয়ে। এক থেকে ৫০ পয়সা পর্যন্ত ধাতব মুদ্রাগুলোর এককভাবে কোনো পণ্য ক্রয়ের সক্ষমতা যত দিন ছিল, তত দিন এদের ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। মানুষ অস্বস্তিও প্রকাশ করেনি। ক্রয়ক্ষমতা হারানোর সঙ্গে এগুলোর প্রতি অনীহা বেড়েছে। এখন যেটা দেখা যাচ্ছে এক ও দুই টাকার কয়েনের ক্ষেত্রে। এ অবস্থায় স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে, যেসব ধাতব মুদ্রা কার্যকারিতা হারিয়ে দীর্ঘদিন পড়ে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের ভল্টে কিংবা ব্যবসায়ীর সিন্দুকে, সেগুলোর ভবিষ্যৎ কী? সন্দেহ নেই, ব্যক্তির হাতে এগুলো এ অবস্থায় দীর্ঘদিন পড়ে থাকলে তিনি এর উপযোগিতা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবেন। বাণিজ্যিক ব্যাংকের ভল্টে থাকলেও সংশ্লিষ্ট শাখা এ অর্থ থেকে কোনো উপযোগ পাবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে থাকার ফল কী হচ্ছে, তাও সহজে অনুমেয়। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি এসবের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, সেটাই সুবিবেচনার পরিচায়ক হবে মনে হয়।

কিছুদিন আগে একটি সার্কুলারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছিল, সেখান থেকে দুই ও পাঁচ টাকা মূল্যমানের নগদ অর্থ তুলতে চাইলে ব্যাংকগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে ৮০ শতাংশ ধাতব মুদ্রা গ্রহণ করতে হবে। বাজারে এ মূল্যমানের কাগুজে মুদ্রার সরবরাহ কমাতেই নাকি জারি হয়েছে এমন নির্দেশনা। অস্বীকার করা যাবে না, এর পেছনে কিছু বাস্তবতা রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন নির্দেশনা জারির পর বাণিজ্যিক ব্যাংক নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির কাছে এ ধরনের নোটের চাহিদা ইচ্ছা করেই কমিয়ে দিয়েছে কি না, তা জানার সুযোগ হয়নি। প্রশ্ন হলো, গ্রাহকরা যে মুদ্রা নিতে অনিচ্ছুক কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনাকাক্সিক্ষত আচরণ করেন, সেই মুদ্রা নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখাগুলো কী করবে? বেশ কিছুদিন আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরেকটি নির্দেশনায় বাণিজ্যিক ব্যাংকের কোনো শাখা গ্রাহকের কাছ থেকে ধাতব মুদ্রা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। প্রশ্ন হলো, বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখাগুলোর জমা কাউন্টারে ধাতব মুদ্রা যদি দেদার গ্রহণ করা হয়, একইভাবে পেমেন্ট কাউন্টারে সেটা যদি বিতরণ করা না যায়ক্সতাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? প্রতিটি কয়েন হিসাব করে জমা নিতে গেলেও কি গ্রাহকসেবা প্রদানে বিঘœ ঘটবে না?

সংগত কারণেই আরেকটি প্রশ্ন উল্লেখ করতে হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাধ্যবাধকতা মেনে বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখাগুলো যদি দুই ও পাঁচ টাকার নোট নগদ প্রদানের ক্ষেত্রে গ্রাহককে ৮০ শতাংশ ধাতব মুদ্রা নেওয়ার শর্ত বেঁধে দেয়, তাহলে শাখায় কী লঙ্কাকাণ্ড বাধবে, সেটা ভেবে দেখেছেন নীতিনির্ধারকরা? মনে রাখা চাই, বাধ্যবাধকতা আরোপ করে প্রতিষ্ঠানকে পরিপালনের আওতায় আনা যতটা সহজÑব্যক্তিকে আনা ততটাই কঠিন। কোনো নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বাস্তবতা যদি বিবেচনায় রাখা না হয়, তাহলে সেটার পরিপালনও ঠিকমতো হয় না। এটা ঠিক, যে মুদ্রার ক্রয়সক্ষমতা নেই, মানুষ সেটা বহন করতে চাইবে না। লেনদেনে এ ধরনের পরিস্থিতিতে আর্থিক উপযোগিতা যাতে হারাতে না হয়, সেজন্য ডিজিটাল মাধ্যমেও সেবা বা পণ্যের মূল্য পরিশোধে উৎসাহী হচ্ছে মানুষ। এক্ষেত্রে উত্তম ও আধুনিক বিকল্প যেহেতু হাতে আছে, তাই সনাতনি পদ্ধতি কার্যকারিতা হারাবেÑসেটাই স্বাভাবিক।

শুরু করেছিলাম ছেলেবেলার গল্প দিয়ে। সেটা শেষ হয়েছিল ৫০ পয়সা মূল্যমানের ধাতব মুদ্রায়। শিগগির এক ও দুই টাকার কয়েন নিয়েও হয়তো এমন স্মৃতিচারণা করতে হবে আমাদের। এক টাকায় এখন চকোলেট ও চুইংগাম ছাড়া তেমন কিছু পাওয়া যায় না। মূল্যস্ফীতি যে হারে হচ্ছে, তাতে দুই ও পাঁচ টাকা মূল্যমানের মুদ্রাও যে শিগগির এককভাবে কোনো পণ্য কেনার ক্ষমতা হারাবে, তাতে সন্দেহ কম। এসবের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া না হলে ভোগান্তি বাড়বে মানুষের; ব্যাংক কর্মকর্তাদেরও। নীতিনির্ধারকরা চলছেন উল্টোপথে। তারা চাইছেন জোর করে এর ব্যবহারে মানুষকে বাধ্য করতে। কয়েন নিয়ে এ বিড়ম্বনা কি তাহলে চলতেই থাকবে?

 

ব্যাংক কর্মকর্তা

zahirul.duÑgmail.com