রোহান রাজিব: রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের বড় দুই খেলাপি শিল্পগোষ্ঠী তাদের ঋণ নিয়মিত করেছে। দুই গ্রুপের ঋণ নিয়মিত করায় এর প্রভাব পুরো ব্যাংক খাতে পড়েছে। গত তিন (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মাসে ব্যাংক খাতে ৬৪২ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ কমেছে। যেখানে আগের প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দিগুণ বৃদ্ধির কারণে পুরো ব্যাংক খাতে এক লাফে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা বেড়ে রেকর্ড ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪০ কোটি টাকায় উঠেছিল। গত তিন মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমলেও বেসরকারি, বিদেশি এবং বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, জুনে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছিল মূলত জনতা ব্যাংকের দুই শিল্পগোষ্ঠীর ঋণ খেলাপি হওয়ার কারণে। তবে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে দুই গ্রুপের খেলাপি ঋণ নিয়মিত করেছে ব্যাংকটি। এতে ব্যাংকটির সব মিলিয়ে তৃতীয় প্রান্তিকে ১১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ কমেছে। এর প্রভাব পড়েছে পুরো ব্যাংক খাতে। তাই তিন মাসে পুরো ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট বিতরণ করা ঋণ ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এর তিন মাস আগে জুন প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪০ কোটি টাকা। সে হিসাবে বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) খেলাপি ঋণ কমেছে ৬৪২ কোটি টাকা বা শূন্য দশমিক ৪১ শতাংশ।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম তিন (জানুয়ারি-মার্চ) মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় এ বছর সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২১ হাজার ১ কোটি টাকা। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমে দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২১ দশমিক ৭০ শতাংশ। গত জুন শেষে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৭৪ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা বা ২৫ দশমিক ০১ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকের তিন মাসে ৭ হাজার ৯০২ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮১ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকায়, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ০৪ শতাংশ। গত জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৩ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা। এছাড়া বিদেশি ব্যাংকে তিন
মাসে ৮৯ কোটি টাকা খেলাপি বেড়ে মোট স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকায় বা ৫ দশমিক ০৭ শতাংশে। জুন শেষে খেলাপি ঋণের স্থিতি ছিল ৩ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। বিশেষায়িত ব্যাংকের তিন মাসে ২৪ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকায় বা ১২ দশমিক ১০ শতাংশে। গত জুন শেষে যা ছিল ৪ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা বা ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ।
জানা যায়, কভিড-১৯ মহামারির কারণে বিগত ২০২০ ও ২০২১ সালে কোনো ঋণ পরিশোধ না করেও খেলাপিমুক্ত ছিলেন গ্রাহকরা। ২০২২ সালে এসব নীতি তুলে দেয়ার পর ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ার প্রবণতা দেখা দেয় চলতি বছরের শুরু থেকে। এ অবস্থায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুনে ব্যাংকঋণ পরিশোধে আবার ছাড় দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে দেশে পুনঃতফসিল করা ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। সুতরাং কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ দেখালেও প্রকৃত খেলাপির পরিমাণ অনেক বেশি। এর বাইরেও মামলার কারণে আটকা আছে আরও এক লাখ ৬৬ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা। ফলে সব মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ হবে ৫ লাখ কোটি টাকার বেশি, যা মোট ঋণের ৩৪ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) পুনঃতফসিল করা ঋণ ও আদালতের স্থগিতাদেশ দেয়া ঋণকে খেলাপি হিসেবে দেখানোর পক্ষে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যাংক খাতে প্রকৃতপক্ষে খেলাপি ঋণ কমেনি। জনতা ব্যাংকের বড় গ্রুপগুলোর যে ঋণ গত প্রান্তিকে খেলাপি হয়েছিল, তা এ প্রান্তিকে নিয়মিত করা হয়েছে। কারণ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খেলাপি হলে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নেই। তাই নির্বাচনে প্রার্থী হতে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করেছে। যদিও ব্যাংক খাতে সার্বিক অবস্থার উন্নতি হয়নি। কারণ অন্যান্য ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, পুনঃতফসিল করে খেলাপি ঋণ কমানো কোনো সমাধান নয়। পুনঃতফসিল করা ঋণও খেলাপি, আইএমএফ এ কথাই বলে। কারণ এসব ঋণ পুনরায় খেলাপি হয়ে যায়। তাই এভাবে পুনঃতফসিল করে খেলাপি ঋণ কমালে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।