রহমত রহমান: দেশীয় ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ উঠেছে ‘সেবা আমদানির’ নামে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। যাচাই হলো। যাচাইয়ে দেখা গেল, সত্যি সত্যিই প্রতিষ্ঠানগুলো এক-দুই টাকা নয়Ñফাঁকি দিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। মূসক আইনের ব্যাখ্যায় এই ফাঁকি কাভার করে না। এনবিআর থেকে ব্যাখ্যাও নেয়া হয়নি। কিন্তু এনবিআরের ‘ভুয়া’ একটি ব্যাখ্যা ব্যবহার করে বছরের পর বছর ‘সেবা আমদানির’ নামে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসছে। কেবল ১৬টি প্রতিষ্ঠানের ১০৬টি মাসিক দাখিলপত্র (ভ্যাট রিটার্ন) যাচাই করা হয়েছে, যাতে প্রতি মাসে সেবা আমদানির নামে প্রতিষ্ঠানগুলো রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে গড়ে প্রায় ৩০ কোটি টাকা, যা বছরে দাঁড়ায় প্রায় ১৩৬ কোটি টাকা। আর পাঁচ বছরে এই ফাঁকির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় এক হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ)-মূল্য সংযোজন করের যাচাই ও অনুসন্ধানে এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে। ফাঁকির তালিকায় রয়েছেÑইউনিলিভার, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, ম্যারিকো, গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক, নেসলে, স্কয়ার, ইনসেপ্টা, র্যাডিসন ব্ল–, ইউনিক হোটেল, ব্র্যাক ব্যাংক, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, এসিআই ও এশিয়াটিক মাইন্ডশেয়ার। সম্প্রতি এই প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এনবিআর সূত্রমতে, মূসক নিবন্ধিত কিছু প্রতিষ্ঠান সেবা আমদানির বিপরীতে ‘রিভার্স চার্জ’র অজুহাতে মূসক আইনের বিধান লংঘন করে আমদানি পর্যায়ে পরিশোধিত ‘উপকরণ রেয়াত’ গ্রহণ, প্রদেয় কর থেকে পরিশোধ হিসেবে প্রদর্শন এবং এর মাধ্যমে প্রকৃত মূসক হ্রাস করে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ পায় এলটিইউ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এলটিইউয়ের একজন যুগ্ম কমিশনারের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানগুলোর রিটার্ন যাচাই ও অনুসন্ধান করা হয়। যাচাইয়ের পর প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ব্যাখ্যাও নেয়া হয়। তবে কিছু প্রতিষ্ঠান এনবিআরের ২০২৩ সালের ৪ অক্টোবরের একটি ব্যাখ্যা এলটিইউকে দেয়। এলটিইউ থেকে এনবিআরে ব্যাখ্যাটি যাচাই করা হয়। যাতে দেখা যায় ব্যাখ্যাটি এনবিআর দেয়নি, প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা বাঁচতে নিজেরা তৈরি করেছে। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো দেখে দেখে সেবা আমদানির ক্ষেত্রে এই ফাঁকি দিয়ে আসছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
এলটিইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৬টি প্রতিষ্ঠানের ১০৬টি ভ্যাট রিটার্ন যাচাই করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দেশি-বিদেশি ব্যাংক, ওষুধ কোম্পানি, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, হোটেল, মোবাইল অপারেটর রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান ‘সেবা আমদানির’ নামে ১৩৬ কোটি ৪৬ লাখ ১৭ হাজার ৪৪৮ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে এলটিইউ। সে হিসাবে প্রতিমাসে ১৬টি প্রতিষ্ঠান গড়ে রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে ৩০ কোটি ৪২ লাখ ৮২ হাজার ৭৬৫ টাকা। হিসাব অনুযায়ী, ১৬টি প্রতিষ্ঠান গড়ে প্রতি মাসে যে রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে, তা পাঁচ বছরে দাঁড়ায় প্রায় এক হাজার ৮২৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এই প্রতিষ্ঠানগুলো ভ্যাট রাজস্ব কম পরিশোধ করায় রাজস্বহানি হয়েছে। তবে প্রকৃত রাজস্ব ফাঁকির বিস্তারিত হিসাব নথিভিত্তিক তদন্তসাপেক্ষে উšে§াচিত হলে এই হিসাবের সঙ্গে কিছুটা কমবেশি হতে পারে। আবার ১৬টি প্রতিষ্ঠানের ১০৬টি রিটার্ন যাচাই করে প্রতি মাসে ও প্রতি বছর প্রতিষ্ঠান অনুযায়ী রাজস্ব ফাঁকি বা হানির গড় হিসাব করা হয়েছে। ১৬টি কোম্পানি প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৩০ কোটি ৪২ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে, যা বছরে দাঁড়ায় প্রায় ৩৬৫ কোটি ১৩ লাখ টাকা। সে হিসাবে ৫ বছরে ফাঁকির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় এক হাজার ৮২৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
এলটিইউর যাচাই ও বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এলটিইউয়ে আওতাধীন ১৬টি প্রতিষ্ঠানের ১০৬টি ভ্যাট রিটার্ন যাচাই করা হয়েছে। যার মধ্যে এসিআই গ্রুপের অ্যাডভান্স কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের (এসিআই) ১১টি রিটার্ন যাচাই করা হয়েছে, যাতে প্রতি রিটার্নে মাসে গড়ে প্রায় ৫ লাখ ৪৭ হাজার টাকা রাজস্বহানি বা ক্ষতি হয়েছে, যা বছরে দাঁড়ায় প্রায় ৬৫ লাখ ৭৪ হাজার টাকা। কোম্পানি ১১টি রিটার্নে ‘ইম্পোটেড সার্ভিস’ নামে সেবা আমদানি দেখিয়ে এই রাজস্ব সুবিধা নিয়েছে। একইভাবে এশিয়াটিক মাইন্ডশেয়ারের দুটি রিটার্ন যাচাই হয়েছে, ‘অ্যাডভার্টাইজমেন্ট’ দেখিয়েছে, যাতে প্রতি রিটার্নে মাসে গড়ে প্রায় দুই কোটি ৮৪ লাখ টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে, যা বছরে দাঁড়ায় প্রায় ৩৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা। বাংলাদেশ সার্ভিসেস (হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল) পাঁচটি রিটার্ন যাচাই হয়েছে, এতে ‘আইজিএইচ ফি’ দেখিয়েছেÑযাতে প্রতি রিটার্নে মাসে গড়ে প্রায় ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে, যা প্রতি বছর দাঁড়ায় প্রায় দেড় কোটি টাকা।
মোবাইল অপারেটর বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশন লিমিটেড চারটি রিটার্ন যাচাই হয়েছে, এতে ‘ইম্পোটেড সার্ভিস’ দেখানো হয়েছেÑযাতে প্রতি রিটার্নে মাসে গড়ে প্রায় এক কোটি থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকা রাজস্ব হানি হয়েছে, যা বছরে দাঁড়ায় প্রায় ১৮ কোটি টাকা। দেশীয় ব্র্যাক ব্যাংক পিএলসির ছয়টি রিটার্ন যাচাই করা হয়েছে, এতে ‘ইম্পোটেড সার্ভিস’ দেখানো হয়েছেÑযাতে প্রতি রিটার্নে মাসে গড়ে প্রায় ৪৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে, যা প্রতিবছর দাঁড়ায় প্রায় ৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। বহুজাতিক মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোন পিএলসির চারটি রিটার্ন যাচাই করা হয়েছে, ‘ফরিন পেমেন্ট’ দেখানো হয়েছেÑযাতে প্রতি রিটার্নে মাসে গড়ে প্রায় ১০ কোটি ২৮ লাখ টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে, যা বছরে দাঁড়ায় প্রায় ১২৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা। গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের ১৩টি রিটার্ন যাচাই হয়েছে, এতে ‘রি-ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম সার্ভিস ইম্পোর্ট’ দেখানো হয়েছেÑযাতে প্রতি রিটার্নে মাসে গড়ে প্রায় ২৮ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে, যা বছরে দাঁড়ায় প্রায় তিন কোটি ৩৯ লাখ টাকা।
ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ১০টি রিটার্ন যাচাই করা হয়েছে, এতে ‘ব্যাংক রিভার্স চার্জ ও ইম্পোর্ট সার্ভিস রিভার্স চার্জ’ দেখানো হয়েছেÑযাতে প্রতি রিটার্নে মাসে গড়ে এক কোটি ৯২ লাখ টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে, যা বছরে দাঁড়ায় প্রায় ২৩ কোটি ১১ লাখ টাকা। বহুজাতিক ম্যারিকো বাংলাদেশ পিএলসির দুটি রিটার্ন যাচাই হয়েছে, এতে ‘ইম্পোটেড মিস্সালানেওয়াস সার্ভিস’ দেখানো হয়েছেÑযাতে প্রতি রিটার্নে মাসে গড়ে প্রায় দুই লাখ ৫৮ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে, যা বছরে দাঁড়ায় প্রায় ৩১ লাখ টাকা। বহুজাতিক নেসলে বাংলাদেশ লিমিটেডের তিনটি রিটার্ন যাচাই করা হয়েছে, এতে ‘ইম্পোটেড সার্ভিস’ দেখানো হয়েছেÑযাতে প্রতি রিটার্নে মাসে গড়ে রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে প্রায় ছয় কোটি ১১ লাখ টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে, যা বছরে দাঁড়ায় প্রায় ৭৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।
বহুজাতিক মোবাইল অপারেটর রবি আজিয়াটা পিএলসির চারটি রিটার্ন যাচাই হয়েছে, এতে ‘ফরিন টেকনিক্যাল সার্ভিস’ দেখানো হয়েছেÑযাতে প্রতি রিটার্নে মাসে গড়ে প্রায় ৫ কোটি ৪ লাখ টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে, যা বছরে দাঁড়ায় প্রায় ৬০ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। সেনা হোটেলের (র্যাডিসন ব্ল–) পাঁচটি রিটার্ন যাচাই হয়েছে, এতে ‘ইম্পোটেড সার্ভিস ও বুকিং ডটকম’ দেখানো হয়েছেÑযাতে প্রতি রিটার্নে মাসে গড়ে প্রায় ৩৩ লাখ ৬৪ হাজার টাকা করে রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে, যা বছরে দাঁড়ায় প্রায় ৪ কোটি টাকা।
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস পিএলসির ১২টি রিটার্ন যাচাই হয়েছে, এতে ‘ইম্পোটেড সার্ভিস’ দেখানো হয়েছেÑযাতে প্রতি রিটার্নে মাসে গড়ে প্রায় ৩১ লাখ ৫৩ হাজার টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে, যা বছরে দাঁড়ায় প্রায় তিন কোটি ৭৮ লাখ টাকা। বহুজাতিক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের পাঁচটি রিটার্ন যাচাই হয়েছে, এতে ‘ইম্পোটেড সার্ভিস ও মিস্সালানেওয়াস সার্ভিস’ দেখানো হয়েছেÑযাতে প্রতি রিটার্নে মাসে গড়ে প্রায় দুই লাখ ৩১ হাজার টাকা করে রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে, যা বছরে দাঁড়ায় ২৭ লাখ টাকা। বহুজাতিক ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের ১৩টি রিটার্ন যাচাই হয়েছে, এতে ‘ইম্পোটেড সার্ভিস ও ফরিন সার্ভিস’ দেখানো হয়েছেÑযাতে প্রতি রিটার্নে মাসে গড়ে প্রায় ৮২ লাখ টাকা করে রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে, যা বছরে দাঁড়ায় প্রায় ৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টের সাতটি রিটার্ন যাচাই করা হয়েছে, এতে ‘ইম্পোটেড সার্ভিস’ দেখানো হয়েছেÑযাতে প্রতি রিটার্নে মাসে গড়ে প্রায় ২৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকা করে রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে, যা বছরে দাঁড়ায় তিন কোটি ২২ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে এনবিআরের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, যেসব কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের সেবা আমদানির নামে রাজস্ব ফাঁকির তথ্য এসেছেÑতা খুবই হতাশাজনক। কারণ এসব কোম্পানিকে এনবিআর কমপ্লায়েন্স হিসেবে দেখে। সেবা আমদানির ক্ষেত্রে রাজস্ব নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু নিজেরা ব্যাখ্যা তৈরি করে এনবিআরের নাম ব্যবহার করা খুবই জঘন্য কাজ। যেসব কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে, এলটিইউ তা আইন অনুযায়ী আদায় করবে এবং ভবিষ্যতে কোনো কোম্পানি যাতে এই খাতে রাজস্ব ফাঁকি দিতে না পারে।