Print Date & Time : 28 July 2025 Monday 10:35 am

সৈয়দপুরে কসাইখানার বেহাল দশা

তৈয়ব আলী সরকার, নীলফামারী: নীলফামারীর সৈয়দপুর পৌরসভার কসাইখানার বেহাল দশা। জায়গার সংকট, চারপাশে ময়লার ভাগাড়, পানির স্বল্পতা, কুকুর ও কাকের উপদ্রব, খোলা জায়গা এবং রোদ-বৃষ্টির আতঙ্ক। এসব কারণে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে কসাইদের। এ পরিস্থিতি সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেই কর্তৃপক্ষের।

ফলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জবাই ও খালগিরি করা হচ্ছে। এ কারণে গোশতে নোংরা লাগা কুকুর ও কাকের থাবায় রোগজীবাণু মিশছে। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় রোগাক্রান্ত, গর্ভবতী ও অসুস্থ পশু জবাই করে সরবরাহ করা হচ্ছে বাজারে, যা অত্যন্ত ক্ষতিকর।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সৈয়দপুর শহরের নয়াবাজার সুরকী মহল্লার ভাগাড় এলাকায় মূল শেডের ভেতরে ও বাইরের খোলা জায়গায় গাদাগাদি করে ২০টি গরু জবাই করে চামড়া ছেলার কাজ করছেন কসাইরা। মেঝেতে রক্ত ও গোবরের স্তুূপের মধ্যে চলছে গোশত কাটার কাজ। পাশে গরুর ভুঁড়ি, চামড়া ও গোশতের উচ্ছিষ্ট ফেলা হয়েছে। সেগুলোয় ঝাঁকে ঝাঁকে কাক আর দলে দলে কুকুরের হুড়োহুড়ি।

ভাগাড়ের ময়লা আবর্জনা মাড়িয়ে কাক-কুকুর ছুটোছুটি করছে শেডের ভেতরে। সেখানে আস্ত চামড়া আর গোশতের ওপরে নোংরা পায়ে বসে ঝিল্লি ছেঁড়ায় ব্যস্ত কাক। একইভাবে সুযোগ বুঝে গোস্তের ওপর দাঁত বসাচ্ছে কুকুর। কখনও কখনও পুরো রান কুকুর টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। অথচ এসব যেন তোয়াক্কা করছেন না গোশত ব্যবসায়ীরা। এমনকি সেগুলো না ধুয়েই তারা রিকশা, ভ্যান ও অটোতে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন দোকানে।

এ দৃশ্য প্রতিদিনের। ছোট-বড় মিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৬০-৭০টি গরু জবাই হয় এই কসাইখানায়। কিন্তু জায়গা না থাকায় একসঙ্গে ১০টির বেশি পশু জবাই করা সম্ভব নয়। এসময় অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় পশুর মালিকদের।

পানিস্বল্পতার কারণে গোশত ধোয়া এবং রক্ত পরিষ্কার করতে বেশি সময় লাগছে। ফলে সব গরুর খালগিরি শেষ করতে সময় লাগে কমপক্ষে প্রায় পাঁচ-সাত ঘণ্টা। এতে ভোর ৫টায় শুরু করলেও শেষ হয় ১২টার পর। শুক্রবার আরও বেশি সমস্যার সৃষ্টি হয়, কারণ এদিন দ্বিগুণ পশু আসে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কসাই বলেন, এরপরও আমরা এখানে পশু জবাই করতে আনি। সারা বছর অনেক কষ্ট করে কাজ করি। বর্ষায় এই ভোগান্তি আরও বেড়ে যায়। এখন রোদে পুড়ছি, আর তখন পানিতে ভিজে নোংরা ময়লায় একাকার হয়ে যায় শেডসহ বাইরের অংশ। কসাইখানা থেকে রাস্তা পর্যন্ত কাদা আর কাদা। এর মধ্যে গরু আনা, জবাই করা এবং গোশত নিয়ে যাওয়া কী যে দুর্ভোগ, তা না দেখলে বোঝানো মুশকিল।

এসময় অপর একজন কসাই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের এই ভোগান্তির কথা বারবার বলেও পৌর কর্তৃপক্ষ বা ইজারাদার কেউ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। অথচ পশুপ্রতি ১০০ টাকা করে দিতে হয়। বিনিময়ে সামান্য সেবাও পাই না। আবার অন্য জায়গায় জবাই করলে এসব ভোগান্তিও নেই, টাকাও লাগে না। কিন্তু আইনের নামে আমাদের এই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তবে এখন অনেকে শহরের বিভিন্ন জায়গায় নিজ নিজ উদ্যোগে পশু জবাই করছে।

অভিযোগ উঠেছে, দুই লাখ ৭০ হাজার টাকার কসাইখানা টেন্ডারের মাধ্যমে নিতে হয়েছে ছয় লাখ ৮০ হাজার টাকায়। সঠিক দরে ইজারা দেয়া হলে কসাইখানার উন্নয়ন করতে পারত ইজারাদার। অথবা সব টাকা যদি পৌরসভার তহবিলে জমা হতো, তাহলে সেই টাকাতেও কাজ করা যেত। কিন্তু টাকা চলে গেছে ব্যক্তিগত পকেটে।

এ ব্যাপারে সৈয়দপুর গোশত ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও কিলখানার ইজারদার মো. নাদিম কোরাইশী জানান, ‘নিজের টাকাই তুলতে পারছি না। সেখানে সেবা কী দেব? ইজারার টাকা দিয়ে উন্নয়ন করতে পারে পৌরসভা। কিন্তু পৌর কর্তৃপক্ষ কোনো কাজই করছে না। অথচ শেডের পরিধি বাড়ানোসহ অন্যান্য সমস্যার সমাধান খুবই জরুরি।

তিনি আরও বলেন, কসাইদের কষ্টের কথা ভেবে একাধিকবার লিখিত আবেদন জানিয়েছি পৌর মেয়রকে। কিন্তু তিনি বারবার আশ্বাস দিলেও কিছু করেননি। পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষায় নিয়োজিত ডাক্তার ও পৌর কর্তৃপক্ষ নিয়মিত আসেন না।

এলাকাবাসীর অভিযোগে জানা যায়, আগামী জুন মাসে আগের টেন্ডারের মেয়াদ শেষ হবে। নতুন করে টেন্ডারের মাধ্যমে ইজারা দিতে আবারও চলবে টাকার খেলা। কিন্তু কিলখানার কোনো উন্নতি হবে না। সাবেক মেয়র আমজাদ হোসেন সরকার ও আখতার হোসেন বাদল যেটুকু করে গেছেন, সেটাকে পুঁজি করেই সবাই পকেট ভারী করছেন।

এজন্য কসাইদের পক্ষে দাবি উঠেছে, দ্রুত বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করা না হলে, প্রয়োজনে ব্যবসা বন্ধ করে দেবেন, নয়তো আন্দোলনে নামবেন তারা। স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও মানসম্মত গোশত সরবরাহে পৌর কর্তৃপক্ষসহ প্রশাসনের সার্বিক হস্তক্ষেপ আশা করেছেন গোশত ব্যবসায়ীরা।

উপজেলা সেনেটারি ইন্সপেক্টর আলতাব হোসেন বলেন, কসাইখানার আর্বজনার ভাগাড়ে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সেখানে কোনো পরিবেশ নাই। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গরু জবাই করা হচ্ছে। তদারকি করতে গেলে সেখানে দুর্গন্ধে থাকা যায় না। বারবার মেয়র ও পৌর পরিষদকে অভিযোগ করে কোনো সমাধান হয়নি।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. শ্যামল কুমার রায় বলেন, কসাইখানায় পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য কোনো লোকবল সেখানে নিয়জিত নেই, কারণ পৌরসভা থেকে এ ব্যাপারে আবেদন করা হয়নি।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা  ডা. আলিমুল বাশার বলেন, গরু জবাইয়ের আগে অবশ্যই গরু স্বাস্থ্য পরীক্ষা জরুরি, অসুস্থ গরু জবাই করা

যাবে না। অসুস্থ বা রোগাক্রান্ত গরুর গোশত খেলে পেটে পীড়া ও ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়া আশঙ্কা বেশি থাকে।

পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘পৌরসভার নিজস্ব কোনো চিকিৎসক বা মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট নেই। তবে কনজারভেন্সি বিভাগের মমিনুল ইসলাম ও তথ্য কর্মকর্তা আকমল সরকার রাজু তদারকির দায়িত্বে আছেন। তারা সঠিক বলতে পারবেন।’ 

সৈয়দপুর পৌরসভার মেয়র ও পৌর মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রাফিকা আকতার বেবীর মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় মন্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।