রহমত রহমান: ২০১৩ সালের ২৪ জুলাই। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি বিমানের কার্গো হোল্ড থেকে জব্দ হয় ১২৪ কেজি সোনা। এটি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সোনার চালান জব্দের ঘটনা। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এই সোনা জব্দ করে। নিয়ম অনুযায়ী মামলা হয়। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্ত শেষে বিমানের ১০ কর্মীসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে। কিন্তু বিমানের মধ্যে সোনা জব্দের ঘটনায় বিমানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ২০১৪ সালে রাষ্ট্রীয় এই বিমান সংস্থার আরেকটি বিমানের টয়লেটের মধ্যে বিশেষ কায়দায় লুকিয়ে রাখা ১০৬ কেজি সোনা জব্দ করা হয়। এটি দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহত্তম সোনা চোরাচালানের ঘটনা। সে সময় বিমানটি জব্দ করে কাস্টমস গোয়েন্দা। কিন্তু ‘মুচলেকা’ নিয়ে বিমানটি ছেড়ে দেয়া হয়। পরে কীভাবে সোনা বিমানের মধ্যে প্রবেশ করলÑতার তদন্ত হয়নি, ব্যবস্থাও নেয়া হয়। এরপর বহুবার বিমান থেকে সোনা জব্দ হলেও, বিমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এ তো গেল সরকারি বিমান সংস্থা। বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলোর বিমানেও একইভাবে বহুবার উড়োজাহাজে বিশেষ কায়দায় লুকানো সোনা আটক হয়েছে। মুচলেকা দিয়ে বিমান ছাড়া হলেও ওই বিমান সংস্থার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সরকারি-বেসরকারি উড়োজাহাজ সংস্থার উড়োজাহাজে কখনও সিটের নিচে, কখনও সিটের হাতল খুলে, কখনও উড়োজাহাজের ক্যাটারিং, কখনও উড়োজাহাজের টয়লেট ইত্যাদি জায়গায় লুকিয়ে সোনা পাচারের সময় আটক হয়। কিন্তু ওই বিমানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। কাস্টমস গোয়েন্দা বলছে, সাধারণত একজন যাত্রী ইমিগ্রেশন শেষে বিমানে প্রবেশ করতে অল্প সময় পান। ফলে এত অল্প সময়ের মধ্যে একজন যাত্রীর পক্ষে বিশেষ কায়দায় সোনা লুকানো সম্ভব নয়। আবার বিমানের যেসব অংশ খুলে সোনা লুকানো হয়, তা বিমানের কর্মী, টেকনিশিয়ান, ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া সম্ভব নয়।
তবে সোনা জব্দ হলেও ওই বিমানের এসব কর্মী বা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। সোনা চোরাচালান রোধ ও সোনা আমদানিতে রাজস্ব আদায় বাড়াতে এবার নড়েচড়ে বসেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সেজন্য যে উড়োজাহাজে সোনা জব্দ হবেÑসেই বিমান জব্দ করে আইনি ব্যবস্থা নেবে এনবিআর। একইসঙ্গে জব্দ উড়োজাহাজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে (সিইও) মামলায় আসামি করে আটক করার কথাও ভাবা হচ্ছে। এই বিষয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ বিমানসহ দেশের সব উড়োজাহাজ সংস্থাকে চিঠি দিয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।
এনবিআর সূত্রমতে, সর্বশেষ ২৭ অক্টোবর ব্যাংকক হতে আসা ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ থেকে প্রায় ৬ কেজি ৯৬ গ্রাম স্বর্ণ জব্দ করে কাস্টমস গোয়েন্দা। উড়োজাহাজের ভেতরে বিশেষ কায়দায় এই স্বর্ণ লুকানো ছিল। উড়োজাহাজটি জব্দ করা হয়। পরে ইউএস বাংলার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ও যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ বিবেচনা করে উড়োজাহাজটি এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষের জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হয়। তবে বিষয়টি এনবিআরের নজরে আসে। কারণ অতীতে যেকোনো উড়োজাহাজে সোনা জব্দ হলে ওই উড়োজাহাজ কর্তৃপক্ষ অভ্যন্তরীণ কোনো তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। যার ফলে চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা পার পেয়ে যায়। উড়োজাহাজ ও উড়োজাহাজের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কাস্টমস গোয়েন্দাকে এনবিআর নির্দেশ দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে উদ্যোগ নেয় কাস্টমস গোয়েন্দা। ১২ নভেম্বর ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসকে চিঠি দেয়া হয়।
যাতে জানতে চাওয়া হয়, ২৭ অক্টোবর জব্দ হওয়া সোনা আমদানির সঙ্গে তাদের এয়ারলাইনসের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত কি না। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কি নাÑতা কাস্টমস গোয়েন্দাকে জানাতে অনুরোধ করা হয়। তবে ইউএস বাংলা এখন পর্যন্ত কোনো জবাব দেয়নি বলে জানা গেছে। ইউএস বাংলার আরেকটি উড়োজাহাজ থেকে অনেকবার সোনা জব্দ করা হয়েছে।
অন্যদিকে, কাস্টমস গোয়েন্দা ‘উড়োজাহাজের অভ্যন্তরে সোনা চোরাচালান প্রতিরোধে সহায়তা চেয়ে রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসসহ দেশের সব এয়ারলাইনসকে ১১ নভেম্বর একটি চিঠি দিয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন উড়োজাহাজের মাধ্যমে দেশে চোরাচালানের উদ্দেশ্যে আসা সোনা কাস্টমস গোয়েন্দা আটক করে। পরবর্তী সময় জব্দ করা সোনা ও জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হয়। কিন্তু যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ বিবেচনায় এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইনানুগ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উড়োজাহাজ অন্তর্বর্তীকালীন ছেড়ে দেয়া হয়। চোরাচালানকৃত সোনা অনেক ক্ষেত্রে উড়োজাহাজের বিভিন্ন পয়েন্ট যেমনÑসিটের নিচে, বাথরুমে, বাথরুমের পাইপের নিচে, ক্যাটারিং এরিয়া, লাগেজ সংরক্ষণের স্থান ইত্যাদি জায়গায় অভিনব কায়দায় লুকানো অবস্থায় পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনসের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত না থাকলে এ ধরনের অপতৎপরতা সম্ভব নয়। এর দায় এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। কাস্টমস গোয়েন্দা বিশ্বাস করে, এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ সচেতন ও কঠোর হলে এ ধরনের সোনা চোরাচালান প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। সেজন্য এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষকে পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়। ভবিষ্যতে উড়োজাহাজে এ ধরনের সোনা চোরাচালান ঘটনা সংঘটিত হলে এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী মামলা দায়েরসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অপরদিকে, ১১ নভেম্বর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হেল্প ডেস্ক উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেছেন, ‘চোরাচালানের ক্ষেত্রে আমরা দেখি আমাদের এয়ারক্রাফটগুলো ব্যবহার করা হয়। প্রয়োজনে আমরা আইন করবÑযেসব এয়ারক্রাফটের বডির ভেতরে স্বর্ণ পাওয়া যাবেÑসেগুলোর দায় এয়ারক্রাফট অথরিটিকে নিতে হবে। যেসব এয়ারক্রাফটের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটবেÑতাদের নিষিদ্ধ করা হবে। তারা এখানে (বাংলাদেশে) রুট পারমিট পাবে না।’ তিনি বলেন, ‘দেশের বাজারে যে পরিমাণ স্বর্ণ আছে আর বৈধভাবে যা আমদানি হয়, এর মধ্যে অনেক গ্যাপ।
এ বিষয়ে কাস্টমস গোয়েন্দার মহাপরিচালক সৈয়দ মুসফিকুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, উড়োজাহাজ থেকে সোনা পাওয়া গেলে এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তা ছেড়ে দেয়া হয়। পরবর্তী সময় কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেÑএমন কথা শুনিনি। ইতোমধ্যে যেসব এয়ারলাইনস হতে সোনা জব্দ হয়েছে এবং এর সঙ্গে উড়োজাহাজ কর্মীদের যোগসাজশের অভিযোগ পাওয়া গেছেÑআমরা সে বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা আমাদের জানাতে বলেছি। যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়া হলে ওই উড়োজাহাজের প্রধান ব্যক্তি যেমনÑব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে দায়ী করে মামলা করার কথা ভাবছি। ভবিষ্যতে যেসব উড়োজাহাজে সোনা জব্দ হবে এবং এর সঙ্গে ওই উড়োজাহাজের কর্মীদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবেÑতখন ওই উড়োজাহাজের এমডি বা সিইওদের বিরুদ্ধেও মামলা করা হবে।