শামিমা নাসরীন: সৌদি আরব থেকে ফিরে আসা এক নারী গত ২৮ আগস্ট বিমানবন্দরের শৌচাগারে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের মাধ্যমে সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। কতটা অসহায় হলে একজন মানুষ আত্মহত্যা করতে চান, সেটা মনে হয় ভুক্তভোগী ছাড়া অনুভব করা সম্ভব নয়। এরপর যখন আত্মহত্যার সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয় এবং সে কারণেই তাকে জেলে যেতে হয়Ñতখন সেই ব্যক্তির মানসিক অবস্থা কেমন হয়, তা অনুভব করার মতো শক্তি আমার নেই। হ্যাঁ, সৌদিফেরত সেই নারী শ্রমিকের আত্মহত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর সেই অপরাধে তার বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং এরপর তাকে জেলে যেতে হয়েছে। কী অদ্ভুত আমাদের নিয়মকানুন! এ শ্রমিককে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করল কে? আর তার শাস্তিই বা কী হবে? না এ ব্যাপারে কোনো তৎপরতা নেই সরকারের। কারণ দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে হলে একটু গভীরে ঢুকতে হবে। আর এটি কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হওয়ার মতোই অবস্থা।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে নেওয়ার পর সেই নারী শ্রমিক তার জীবনের করুণ কাহিনি শোনান। গণমাধ্যমে তা প্রকাশ করাও হয়েছে। তিনি সৌদি আরবে কর্মরত অবস্থায় নির্যাতনসহ সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মীদের দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার কথাও বলেছেন। এরপর তাদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে দেশে ফিরে বিমানবন্দরে এসে শেষ সম্বলটুকুও খুইয়েছেন। এরপর বেঁচে থাকার কোনো অর্থ খুঁজে না পেয়ে একটি চিরকুট লিখে রেখে বিমানবন্দরের শৌচাগারে গিয়ে বিষপান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। নিয়তির নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে এখন তিনি জেলে। এই যে তিনি আত্মহত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হলেনÑএটিকে তার সৌভাগ্য বলব, নাকি চরম দুর্ভাগ্য বলব, ঠিক বুঝতে পারছি না। অনেকেই হয়তো বলবেন ভাগ্য ভালো যে বেঁচে গেছেন। আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না। কারণ তার জীবনের চরম যাতনার পর্ব শুরু হলো বলেই মনে হচ্ছে আমার।
জেলে থাকার কথা কার, আর আছেন কে এ প্রশ্ন দিয়েই শুরু করি। বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিকদের এত নির্যাতনের ঘটনার পরও কেন তাদের পাঠানো হচ্ছে? কেন তাদের এসব দুর্দশার কথা এতটুকুও ভাবা হচ্ছে না। এসব শ্রমিকদের মাথা থেকে বাদ দেওয়াও কি উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ? নাকি তারা উন্নয়নের মহসড়কের নিচে চাপা পড়েছে? দরিদ্র এ জনগোষ্ঠীর কথা ভাবলে তো প্রাসাদে উইপোকার ঢিবি বের হবে। এটাও তো উন্নয়নের খুঁত। শুধু তা-ই নয়, উইপোকার ঢিবি থেকে রত্নাকর বের হলে তো আবার ভয়েরও ব্যাপার। আর সেই রত্নাকর তো সরকারি নাও হতে পারে। এতকিছু জানার পরও কার স্বার্থে, কারা এদের পাঠাচ্ছে? তাদের কেন খুঁজে বের করা হচ্ছে না? কেন তাদের জবাবদিহি করা হচ্ছে না? কপাল ফেরানোর স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে গিয়ে যে নারী সারা শরীরে নির্যাতনের দগদগে ঘা নিয়ে এবং ধর্ষিত হয়ে ফিরছে দেশে, তাদের নির্যাতনকারী মানুষরূপী হায়েনাগুলো কারা? হয়তো এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর আমরা পাব না।
প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের এসব মানুষের ছুটে চলা শুধু দু’মুঠো খাবারের সন্ধানে। দেশ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির খবর রাখার সময় তাদের নেই। সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর টেলিভিশন দেখা বা সংবাদপত্র পড়ার শক্তি বা মানসিকতা কোনোটাই থাকার কথা নয়। স্বাভাবিকভাবেই বিদেশগামী শ্রমিকরা কতটা কষ্টে বা সুখে থাকে তাও জানার কথা নয়। তাদের ধারণা বিদেশে গেলেই হয়তো সব দুঃখ-কষ্ট দূর করা সম্ভব হবে। কিন্তু যারা নিজেদের স্বার্থে এদের কাছে চড়া দামে স্বপ্ন বিক্রি করে খাচ্ছে, তাদের শাস্তি দেবে কে? আর কেমন শাস্তি দিলে এ অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত সম্ভব? অবশ্য সেটি নির্ধারণের জন্য অন্ধ প্রশাসনকে দায়িত্ব না দিয়ে নির্যাতিতদের ওপর ছেড়ে দিলেই বোধ হয় যথাযথ কারণ নির্ধারণ করা সম্ভব হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল সৌদিফেরত এক নারী শ্রমিককে নির্যাতনের, যার সারা শরীরে ফোস্কা উঠেছে আগুনের ছ্যাঁকায়। তার ভাষ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন ছয় থেকে সাতবার তাকে লোহার রড বা ওই জাতীয় কিছু দিয়ে আগুনের ছ্যাঁকা দেওয়া হতো।
নির্যাতনের ভয়াবহতা কত বেশি, তা দেশে ফিরে আসা নারী শ্রমিকদের কাছ থেকে শুনলে কিছু টের পাওয়া যায়। পুরোপুরি তিনিই বোঝেন যিনি এর শিকার। বেতন নিয়মিত না পেলেও প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন কখনও বাকি থাকত না। এমনকি অনেকেই অভিযোগ করেছেন, খাবারও পর্যাপ্ত দিত না তাদের। আরও ভয়ংকর তথ্য উঠে এসেছে তাদের বর্ণনায়। মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে বিয়ে খুবই ব্যয়বহুল ও জটিল পদ্ধতি। এ কারণে অনেকের সামর্থ্য হয় না বিয়ের খরচ জোগাতে। আর সে কারণেই তারা বাঙালি অসহায় নিরীহ নারী শ্রমিকদের জোর করে নিয়ে গিয়ে ভয়াবহ যৌন নির্যাতন চালায়। আর সেক্ষেত্রে একজন পুরুষ নয়, কয়েকজন পুরুষ দলবেঁধে নির্যাতন চালায়। এমন দলবেঁধে ধর্ষণের শিকার নারীর সংখ্যা বহু। এসব দেশে যাওয়া নারী শ্রমিকরা বাঁচার তাগিদে পালিয়ে দূতাবাসে গেলে সেখানকার কর্মকর্তারাও অনেকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আবার কেউ কেউ সেখানেও বিভিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
তবে প্রশাসনের মাথারা অবশ্য বরাবরের মতোই অস্বীকার করেছেন সেসব অভিযোগ। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নমিতা হালদার তো বলেই ফেললেন, ‘যারা দেশে ফিরছেন, তারা নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরছেন না, বরং দেশে ফিরে নির্যাতনের গল্প ফাঁদছেন।’ বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও সত্যিই হাস্যকর বিষয় হলো, আমাদের রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের কেউ কেউ সংবাদপত্র বা টেলিভিশনে খবরও দেখেন না। তা না হলে চোখের সামনে ভেসে বেড়ানো জলজ্যান্ত ঘটনাগুলোকে ‘ফাঁদানো গল্প’ বলতে পারেন কীভাবে? শুধু সংবাদমাধ্যম নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তো এসব ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। তাহলে কীভাবে তিনি বললেন, এসব ফাঁদানো গল্প।
গত তিন বছরে পাঁচ হাজার নারী কর্মী দেশে ফিরেছেন (ডয়েচে ভেলে, ২৫ মে ২০১৮)। তাদের অধিকাংশের নির্যাতনের বর্ণনার কিছু বিষয় ছিল যেসব একই রকম। যেমন আগুনের ছ্যাঁকা, বৈদ্যুতিক শক, লাঠি বা ভারী কিছু দিয়ে মারধর, যৌন নির্যাতন, বেতন না দেওয়া ও খাবার ঠিকমতো না দেওয়া। শুধু তা-ই নয়, অনেকেই বলেছেন তাদের বিভিন্ন মালিকদের কাছে বিক্রি করা হতো এবং পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হতো। এদের মধ্যে অনেকেই আবার যৌন নির্যাতনের কারণে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে দেশে ফিরেছেন। এ রকম একজনকে তার পরিবারও ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করেছে। বর্তমানে তিনি ‘ব্র্যাকের সেইফ হোমে’ আছেন। বাংলাদেশি নারী শ্রমিকরা সৌদি আরবে কোনো স্বাধীন মানুষ ছিলেন না। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে, সেখানে তারা মধ্যযুগীয় দাসপ্রথার শিকার হয়েছিলেন। ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, চলতি বছরের প্রত্যেক মাসে গড়ে ২০০ জন করে নারী শ্রমিক দেশে ফিরেছেন। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মে মাস পর্যন্ত ৪০ হাজার নারী শ্রমিক দেশে ফিরেছেন।
ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কাসহ বেশ কয়েকটি দেশ সৌদি আরবে নির্যাতনের কারণে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করে দেয়। অথচ বাংলাদেশের কর্মীদের পাঠানোর বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে অনেকেই এর বিরোধিতা করলেও তা গায়ে মাখেনি সরকার। এমনকি সেখানে পাঠানোর পর যেন কোনো নির্যাতনের ঘটনা না ঘটে, সেজন্য কোনো ব্যবস্থাও গ্রহণ করেনি বাংলাদেশ সরকার। তাই বারবার প্রশ্ন ঘুরপাক খায় কেন, কার স্বার্থে এ গরিব মানুষগুলোর সঙ্গে এমন নোংরা খেলা চলছে। ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘সৌদি আরব জানে, বাংলাদেশের পক্ষে এর (নির্যাতনের) প্রতিকার দাবি করা সম্ভব নয়।’ বাস্তবতাও তো এমনই দেখছি আমরা। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বরং অস্বীকার করে বেড়াচ্ছেন। অতিদ্রুত সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ না করলে পরিস্থিতি হবে আরও ভয়াবহ। শুধু নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করাই নয়, নির্যাতিত এসব নারী শ্রমিককে আর্থিকভাবে পুনর্বাসনের পদক্ষেপ নেওয়াও দরকার।
গণমাধ্যমকর্মী