সৌরবিদ্যুৎই হবে ভবিষ্যতের সর্বাপেক্ষা টেকসই জ্বালানি

 

ওয়ার্নার ভ্যান জিল: মানুষ প্রতি সেকেন্ডে ২২১ টন কয়লা, এক হাজার ৬৬ ব্যারেল তেল ও ৯৩ হাজার ঘনমিটার প্রাকৃতিক গ্যাস খরচ করছে। এ প্রাকৃতিক সম্পদগুলো শিল্পবিপ্লবের জন্য ছিল অপরিহার্য। ১৮ শতকে ব্রিটেনে শুরু হওয়া শিল্পবিপ্লবে কয়লা ও খনিজ তেল ‘নব্য জ্বালানি’ হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহƒত হয়। কিন্তু একুশ শতকের শুরুতে সময় এসেছে নব্য জ্বালানি নিয়ে নতুন করে ভাবার। আমাদের গ্রহে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থা। সেখানে জীবাশ্ম জ্বালানির কোনো স্থান থাকতে পারে না। একে বদলে গ্রহণ করতে হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস। কিন্তু কোন উৎসটি বেছে নেব আমরা?

কদিন আগে হোক বা পরে, আমাদের বোঝা দরকার যে সৌরশক্তিই একমাত্র দীর্ঘমেয়াদি নবায়নযোগ্য জ্বালানি। এটা একেবারে প্রমাণিত যে বায়ু, নিউক্লিয়ার, জৈবপুঞ্জ (বায়োম্যাস), ভূতাপীয় (জিওথারমাল) অন্য যে কোনো নবায়নযোগ্য জ্বালানির চেয়ে সৌরশক্তি হাজার গুণ বেশি সম্ভাবনাময়। সে পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সৌরশক্তির তাত্ত্বিক সম্ভাব্যতা ৮৯ টেরাওয়াট যা ৪৮০ এক্সাজুলের সমান। মাত্র ৯০ মিনিটে সূর্য থেকে ভূপৃষ্ঠে আছড়ে পড়ে ৪৮০ এক্সাজুল শক্তি যা কি না, ২০০১ সালে গোটা বিশ্বে মোট ব্যয়িত শক্তির (৪৩০ এক্সাজুল) চেয়ে বেশি।

আফ্রিকার ভবিষ্যৎ শক্তি হওয়া উচিত অফগ্রিড সোলার। এটি এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে কেন্দ্রীয় বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিটারের মতো দূরবর্তী কোনো কাঠামোর সহায়তা প্রয়োজন হবে না। বরং এটি একটি একক স্বাধীন বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা। গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের জন্য এটি একেবারে যথোপযুক্ত। আফ্রিকাজুড়ে প্রায় ৬২ কোটি মানুষ আজও বিদ্যুৎ সুবিধাবঞ্চিত। বিদ্যুৎ সুবিধা তাদের মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। আর এজন্য ভবিষ্যতের বিদ্যুৎ সমাধানে আমাদের গ্রিডের বাইরে চিন্তা করতে হবে। টেকসই জ্বালানিবিষয়ক উচ্চ স্তরের একটি কোর্সে শিক্ষকতাকালে পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি যে, টেকসই জ্বালানি সমাধানের জন্য একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি অ্যাপ্রোচ দরকার। এর জন্য রসায়ন, জৈব পদার্থবিদ্যা, জীববিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো বিষয়ের দক্ষতার সমন্বয় প্রয়োজন।

উদাহরণস্বরূপ, সালোকসংশ্লেষণ হলো জীবন বাঁচিয়ে রাখার প্রাকৃতিক উপায় এবং এর পূর্ণাঙ্গ ধারণাকে জ্ঞানের অনেক শাখার সঙ্গেই সম্পৃক্ত করা সম্ভব। টেকসই জ্বালানির উপায় সন্ধানেও সালোকসংশ্লেষণ থেকে বিজ্ঞান কিছু শিখতে পারে কি? হ্যাঁ, পারে। এ পদ্ধতির নাম হলো কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষণ (আর্টিফিসিয়াল ফটোসিনথেসিস)। এ পদ্ধতিতে সোলার ফার্মগুলোতে বড় আকারের ফটোভল্টাইক প্যানেল বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পাতানো থাকে। শহরাঞ্চলেও কাচের মতো স্বচ্ছ সৌর সেলগুলো সাজিয়ে ফেলা সম্ভব।

সূর্যকে ‘হ্যাঁ’ বলুন

মানবজাতির জন্য শক্তি হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ এবং সৌরশক্তি হলো চূড়ান্ত শক্তির উৎস। শক্তির উৎস হিসেবে সূর্যের কিছু অনন্য সুবিধা রয়েছে। এটি সীমাহীন, অফুরান। সূর্য কোনো বৈষম্য করে না, সবাইকে সমান সুযোগ দেয়। বর্তমানে পৃথিবী ১৭ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন (১৭ টেরাওয়াট) হারে শক্তি ভোগ করে, যা ২০৫০ সাল নাগাদ ৩০ টেরাওয়াটে পৌঁছাতে পারে, যদি বর্তমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অপরিবর্তিত থাকে। সমগ্র মানবজাতি যে পরিমাণ সৌরশক্তি ভোগ করতে পারে, তার চেয়ে অনেক গুণ শক্তি সূর্য থেকে পৃথিবীতে বিকিরিত হচ্ছে। যদি যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনা করা যায়, তবে কেবল সূর্য থেকেই প্রয়োজনের থেকে বেশি শক্তি পাওয়া সম্ভব।

ভূপৃষ্ঠে সূর্যের শক্তি সম্ভাব্যতা এক লাখ ২০ হাজার টেরাওয়াট। বাস্তবতা নিরিখে ধরেই নিলাম, মাত্র ১০ শতাংশ দক্ষতা ও মাত্র ২ শতাংশ ভূপৃষ্ঠকে ব্যবহার করা সম্ভব হলো। তা হলেও এ থেকে আমরা ৫০ টেরাওয়াট শক্তি পেতে পারি, যেখানে বায়ু থেকে ২-৪ টেরাওয়াট, নিউক্লিয়ার থেকে ৮ টেরাওয়াট, বায়োম্যাস থেকে ৫-৭ টেরাওয়াট ও জিওথারমাল থেকে ১২ টেরাওয়াট শক্তি পাওয়া সম্ভব। এ থেকেই পরিষ্কার সমাধান পাওয়া যায়। সূর্যের দিকেই মনোযোগ দিতে হবে। অন্য কোনো মাধ্যম এ পরিমাণ শক্তির জোগান দিতে পারবে না। সৌর ও বায়ুর সমন্বিত শক্তি আফ্রিকার ভবিষ্যৎ শক্তি জোগানদাতা হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু আফ্রিকার জন্য মূল চ্যালেঞ্জ হলো সৌরশক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য একে তাপ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি শক্তিতে রূপান্তরিত করার প্রযুক্তি গ্রহণ করা।

নতুন প্রযুক্তি

সৌরশক্তিকে বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তরের জন্য কালো সোলার ফটোভল্টাইক (পিভি) প্যানেল সবচেয়ে পরিচিত। এ প্রযুক্তিতে বিরাট এক পরিবর্তন হতে পারে স্বচ্ছ পিভি প্যানেলের ব্যবহার। তাহলে যে কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত সাধারণ কাচেও এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা সম্ভব হবে। যেমন বড় ভবনের উল্লম্ব কাচের দেয়ালও হতে পারে ভবনের শক্তির উৎস।

অনিক্স সোলার নামে একটি কোম্পানি ২৫টি দেশে ৭০টি প্রকল্পের মাধ্যমে ভবনের জন্য পিভি কাচ ব্যবহারের ধারণাটির প্রমাণ দেখিয়েছে। এ কোম্পানির একমাত্র বর্তমান প্রতিদ্বন্দ্বী উবিকুয়েটাস এনার্জি আবার বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে মোবাইল ডিভাইসের ওপর। এতে মোবাইল ফোনের স্ক্রিন হবে শক্তির উৎস, ফলে ব্যাটারি হয়ে পড়বে অনাবশ্যক। সহজ ভাষায় বলা যায়, সালোকসংশ্লেষণ হলো এমন একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে সবুজ উদ্ভিদ সূর্যের আলো ব্যবহার করে রাসায়নিক বিক্রিয়া সচল রাখে। এ বিক্রিয়া পানির কোষকে ভেঙে এর গাঠনিক উপাদান অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনে বিভক্ত করে।

কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যা আমাদের প্রয়োজন মেটাতে হাইড্রোজেন গঠনের মতোই প্রাকৃতিক সালোকসংশ্লেষণের কাজ অনুকরণ করে। যেহেতু হাইড্রোজেনকে আগামী দিনের জ্বালানি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাই সূর্যালোক থেকে শক্তির পাশাপাশি হাইড্রোজেন মজুদের ব্যাপারেও বিস্তর গবেষণা দরকার।

পারমাণবিক শক্তিকে ‘না’ বলুন

দক্ষিণ আফ্রিকায় পারমাণবিক শক্তি প্রকল্পগুলো বৈজ্ঞানিক কারণে নয় বরং রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যই গড়ে উঠেছে। সৌভাগ্যবশত গত এপ্রিলে দক্ষিণ আফ্রিকার উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সব পারমাণবিক চর্চার নতুন কোনো অগ্রগতি থামিয়ে রাখা গেছে। এখন পারমাণবিক শক্তিকে বেছে নেওয়ার মতো মহাপাপ আবার না করলেই হয়! এক্ষেত্রে আমাদের দুটি পরিণামের কথা মাথায় রাখতে হবে।

আটটি তো পরের কথা, একটি পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্র চালু করতেই অন্তত ১০ বছর সময় ও কোটি কোটি র‌্যান্ড (দক্ষিণ আফ্রিকার মুদ্রা) খরচ হয়। একবার চালু হওয়ার পরই এসব কেন্দ্র সারা জীবন চলবে তা নয়, বরং ৫০ বছর পর একই পরিমাণ সময় ও অর্থ খরচ করে আবার নতুন করে চালু করতে হয়। ধরে নিলাম, দক্ষিণ আফ্রিকা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ ও পারমাণবিক প্লান্টে পরিপূর্ণ একটি দেশ। অথচ এ সুবিধাগুলোই সন্ত্রাসীদের প্রধান লক্ষ্য, যার নিরাপত্তা বিধানও অনেক ব্যয়বহুল। তাহলে এত বড় ঝুঁকি নেওয়ার মানে কী?

চেরনবিল পারমাণবিক বিপর্যয়ের ৩১ বছর পার হয়েছে। এটি ইউক্রেনকে ধ্বংস করে ছেড়েছিল। প্লান্টের চারপাশের ২ হাজার ৬০০ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা আজ অবধি মনুষ্য বসবাসের অযোগ্য বলে বিবেচিত। বিশাল একটি তেজস্ক্রিয়তা ঢাল (রেডিয়েশন শিল্ড) এ এলাকা থেকে দাগ দূর করার কাজ করছে। যখন সূর্যের মধ্যেই এত সম্ভাবনা রয়েছে, তখন দক্ষিণ আফ্রিকার এ ধরনের ঝুঁকি নেওয়ার কোনো মানে হয়?

 

কোয়াজুলু নাটাল ইউনিভার্সিটির রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম থেকে ভাষান্তর

শামসুন নাহার রাখী