কাজী সালমা সুলতানা: বাঙালি যুবক রাজেক হাসান লন্ডনের একটি দোকানে কেনাকাটা করছিলেন। তার হাতে ছিল একটি বই। বইয়ের প্রচ্ছদে হিটলারের ছবি দেখা যাচ্ছিল। দোকানের সেলসগার্ল সাদা চামড়ার ব্রিটিশ একটি মেয়ে হঠাৎ তার হাত থেকে বইটি নিয়ে সেকেন্ডের মধ্যেই ফেরত দিল। বইটি এমনভাবে ঘুরিয়ে ফেরত দিল যে, তখন হিটলারের ছবি আর দেখা যাচ্ছিল না। এরপর একটা হাসি দিয়ে মেয়েটা বলল, ‘নাউ ইট লুকস বেটার’।
২০১৩ সালে ডর্টমুন্ডের বিখ্যাত ভেস্টফালন স্টেডিয়ামে খেলেছিল বোরশিয়া ডর্টমুন্ড ও স্টুটগার্ট। স্টেডিয়ামে এক ডর্টমুন্ডের সমর্থক পিলারের ওপর উঠে হিটলারের স্বাক্ষর দেখাল। খেলায় ডর্টমুন্ড ৬-১ গোলে জিতে যায়। এটা ছিল স্টুটগার্টের বিপক্ষে ডর্টমুন্ডের বিশাল ঐতিহাসিক বিজয়। কিন্তু ঐতিহাসিক বিজয়কে ছাপিয়ে সেই ফ্যান হয়ে উঠল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ডর্টমুন্ড ক্লাব সেই সমর্থককে ২০১৭ পর্যন্ত জার্মানির সব স্টেডিয়াম থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এই ঘোষণার প্রতি সমর্থন জানিয়ে পরের খেলায় ‘নাৎসিরা থাকুক বাইরে’ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে স্টেডিয়ামে হাজির হলো হাজার হাজার ডর্টমুন্ড সমর্থক।
জার্মানির স্কুলে সব শিক্ষার্থীর আবশ্যকীয় পাঠ্য নাৎসি ইতিহাস। সেখানে বলা হয়, কেন হিটলার ও তার ফ্যাসিবাদ মানব সভ্যতার জন্য অভিশাপ হয়ে এসেছিল। কেন নাৎসি বাহিনীর আদর্শ মানবতা বিরোধী ছিল, কেন সব জার্মান নাগরিককে সচেতন হতে হবে, যেন এমন ঘটনার আর কখনোই পুনরাবৃত্তি না ঘটে। শুধু তাই নয়, জার্মানিসহ আশপাশের কয়েকটি দেশে মানবতাবিরোধী কুখ্যাত হিটলার এবং তার নাৎসি বাহিনীর যে কোনো প্রশংসা, সমর্থন বা চিহ্ন প্রদর্শন, গণহত্যাকে অস্বীকার করা ইত্যাদি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
একবার ৩০ বছর বয়সী অতি উৎসাহী এক কানাডীয় পর্যটক ২০১১ সালে বার্লিনে নেমেই জার্মান পার্লামেন্ট ভবনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় এবং ডান হাত উঁচু করে নাৎসি কায়দায় স্যালুট দেয়ার ছবি তোলে। টহল পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রেপ্তার করে কয়েক ঘণ্টা আটক করে রাখে। অবশেষে মোটা অঙ্কের জরিমানা দিয়ে ওই কানাডিয়ান যুবক মুক্তি পায়। সম্প্রতি চিলির এক ছাত্র জার্মানিতে পড়তে এসে প্রথম দিনই বার্লিনে সেই একই কাণ্ড করে। খবর পেয়ে তার স্বদেশি বন্ধুরা পুলিশের কাছে ছুটে যায় এবং অনেক কষ্টে ২ হাজার ইউরো জরিমানা দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে আনে। কোনো জার্মান নাগরিক এই কাজ করলে ৬ মাসের কারাদণ্ড সেই সঙ্গে অর্থদণ্ডও গুনতে হয়।
অনেকেই এখনও জার্মানিকে হিটলারের দেশ বলে চিহ্নিত করতে চায়। কিন্তু জার্মানিতে হিটলার ও তার আদর্শ যতটা ঘৃণ্য, বিশ্বে আর কোথাও ততটা নয়। ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের মাধ্যমে সব নাজি ও তাদের অঙ্গ সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ হয়েছিল। এ বিচারের সময় যেসব নাজির অপরাধ মৃত্যুদণ্ডতুল্য নয়, তাদেরও দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়। অর্থাৎ গোটা জার্মানিকে নাজিমুক্ত করা হয়েছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায় বিপুলসংখ্যক নাজি দক্ষিণ আমেরিকা বিশেষত আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলে আশ্রয় নেয়। আমরা পারিনি জার্মানির মতো কোনো আইন তৈরি করতে। দেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশেরও উচিত ছিল রাজাকার-আলবদর-আলশামসসহ সব স্বাধীনতাবিরোধীকে এ দেশ থেকে চিরতরে বিতাড়িত করে দেয়া। সেটা না করার ফলে তাদের উত্তরসূরিরা আজ বারবার স্বাধীনতাকে হুমকিতে ফেলছে।
১৯৭১ সালে এক সশস্ত্র যুদ্ধের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় ঘটে। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণগত্যা, অগ্নিসংযোগ, শিশু হত্যা, নারীর সম্ভ্রমহানিসহ মানবতার বিরুদ্ধে সব ধরনের অপরাধ সংঘটিত করে। নয় মাসব্যাপী যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহিদ হন আর প্রায় পাঁচ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ঘটে। অবশেষ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ৯৩ হাজার সৈন্য ও তাদের সহযোগী বাহিনীসহ আনুষ্ঠানিকভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণ করে। বিশ্বের ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বাংলাদেশেই পরাজিতরা লিখিতভাবে আত্মসমর্পণ করে। এই আত্মসমর্পণের দলিলে বলা হয়, পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশের যৌথবাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সব সশস্ত্র বাহিনী ও তাদের নিয়ে আত্মসমর্পণে সম্মত হলো।
পাকিস্তানের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীসহ সব আধা সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেত্রে এই আত্মসমর্পণ প্রযোজ্য হবে। এই বাহিনীগুলো যে যেখানে আছে, সেখান থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কর্তৃত্বাধীন নিয়মিত সবচেয়ে নিকটস্থ সেনাদের কাছে অস্ত্রসমর্পণ ও আত্মসমর্পণ করবে। এই দলিল স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড লেফটেন্যান্ট-জেনারেল অরোরার নির্দেশের অধীন হবে। নির্দেশ না মানলে তা আত্মসমর্পণের শর্তের লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধের স্বীকৃত আইন ও রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আত্মসমর্পণের শর্তাবলির অর্থ অথবা ব্যাখ্যা নিয়ে কোনো সংশয় দেখা দিলে, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত। লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আত্মসমর্পণকারী সেনাদের জেনেভা কনভেনশনের বিধি অনুযায়ী প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান দেয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করছেন এবং আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সামরিক ও আধা সামরিক ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ও সুবিধার অঙ্গীকার করছেন। লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধীন বাহিনীগুলোর মাধ্যমে বিদেশি নাগরিক, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও জন্মসূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যক্তিদের সুরক্ষাও দেয়া হবে।’
এই দলিল স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার নির্দেশের অধীন হবে। নির্দেশ না মানলে তা আত্মসমর্পণের শর্তের লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে এবং যুদ্ধের স্বীকৃত আইন ও রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। আত্মসমর্পণের শর্তাবলির অর্থ অথবা ব্যাখ্যা নিয়ে কোনো সংশয় দেখা দিলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত।
এ দলিল মোতাবেক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্যারামিলিটারি ফোর্স হিসেবে রাজাকারদেরও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতোই ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি।
২০০০ সালের ১৪ আগস্ট আরমানিটোলায় পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে ভবনের ছাদে পাকিস্তানের পতাকা উড়ানোর ধৃষ্টতা দেখায় কুখ্যাত মোনায়েম খানের মেয়ে জামাই এবং যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর চাচা শ্বশুর জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল পরিবার। এই ধৃষ্টতার প্রতিবাদ করেছিল ওয়ার্ড আওয়ামী লিগের তৎকালীন সহসভাপতি কামাল হোসেন। কামাল হোসেন ব্যানার হাতে মিছিল করেন। সেই ব্যানারে লেখা ছিল, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে জাহাঙ্গীর আদেলের বাসায় পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে কেন, প্রশাসন জবাব চাই।’ প্রতিবাদের এক পর্যায়ে জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল সেই পতাকা নামিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়। পরদিন ১৫ আগস্ট জাহাঙ্গীর আদেলের দুই ছেলে জোবায়েদ আদেল ও তারেক আদেলের নেতৃত্বে ৮ থেকে ১০ জন সন্ত্রাসী রাজপথে প্রকাশ্যে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে কামালকে। প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য এবং অস্ত্রের ব্যালিস্টিক রিপোর্টে প্রমাণ হওয়া সত্ত্বেও ২০০৩ সালে নি¤œ আদালত থেকে সব আসামিকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী চলছে। জাতীয়ভাবে দিবস উদযাপন উপলক্ষে পালিত হচ্ছে নানা কর্মসূচি। সেই সময়ে সফররত পাকিস্তান ক্রিকেট দল মাঠে প্র্যাকটিসের সময়ে নিজ দেশের পতাকা উড়ানো নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। সফররত যেকোনো দলকেই যে দেশ সফর করে সেই দেশের বিদ্যমান আইন-কানুন মেনে চলতে হয়। এটা যেকোনো সভ্য দেশের রীতি। এ বিষয়ে পাকিস্তান ক্রিকেট দল বা সে দেশের ক্রিকেট বোর্ড ভালোভাবেই জানে। কারণ তাদের ক্রিকেট দল এর আগেও বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সফর করেছে। তাই প্র্যাকটিস মাঠে নিজ দেশের জাতীয় পাতা উড়ানো যায় কি না, তা ভালোভাইে তারা জানেন। তারপরও এমন আচরণ একদিকে যেমন আইনের লঙ্ঘন, অন্যদিকে অখেলোয়াড়সুলভ আচরণও বটে।
বাংলাদেশ পতাকা আইন অনুযায়ী (১) বাংলাদেশে অবস্থিত কূটনৈতিক মিশনসমূহের চ্যান্সারি ভবন এবং কনস্যুলার অফিসসমূহে বিদেশের ‘জাতীয় পতাকা’ উত্তোলন করা যাইতে পারে। অধিকন্তু কূটনৈতিক মিশনসমূহের প্রধানগণ তাহাদের সরকারি ভবন এবং মোটর গাড়িতে তাহাদেও ‘জাতীয় পতাকা’ উত্তোলন করিতে পারিবেন।
(২) বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ভ্রমণকালে নিম্নবর্ণিত শ্রেণির সম্মানিত বিদেশি ব্যক্তিগণ তাহাদের নিজস্ব পতাকা অথবা নিজস্ব পতাকা না থাকিলে তাহাদের দেশের জাতীয় পতাকা তাহাদের অফিসিয়াল বাসভবনে এবং মোটর গাড়িতে উত্তোলন করিতে পারিবেন: (ক) রাষ্ট্রপ্রধান; (খ) ভ্রমণরত প্রধানমন্ত্রী; (গ) বিদেশি সরকারের মন্ত্রীবর্গ।
(৩) বাংলাদেশে অবস্থিত কূটনৈতিক মিশনসমূহ কোন উপলক্ষে, যেমনÑজাতীয় দিবসসমূহে কূটনৈতিক মিশন প্রধানের বাসভবন বা চ্যান্সারি ব্যতীত, যে স্থানে সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হইবে, সেই স্থানে তাহাদের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করিতে পারিবে, তবে শর্ত থাকে যে, সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ‘পতাকা’ও সম্মানজনক স্থানে পাশাপাশি উত্তোলন করিতে হইবে।
উপরিউক্ত বিধিতে উল্লিখিত সুবিধাদি কেবলমাত্র সেই সকল দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হইবে, যাহারা পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকেও অনুরূপ সুবিধা প্রদান করিবে।
(৪) উপরিউক্ত বিধিসমূহের বর্ণনা ব্যত