বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি ডলারে সম্পাদিত হওয়ায় বড় খেসারত দিতে হয় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। গত এক বছরে ডলারের দাম ৮৫ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৯ টাকা। এতে এক বছরে পিডিবির বাড়তি ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। তারপরও নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি হচ্ছে ডলারে।
এমনিতেই ডলারের দাম নিয়ে বিপাকে আছে রাষ্ট্র। দেশে মার্কিন ডলারে জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) আকার বেশি দেখানোর জন্য ডলারের দাম ধরে রাখা হয়েছিল। এখন সেটার মাশুল দিতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, চুক্তিতে বিল টাকায় হিসাব করার শর্ত থাকলে বাড়তি ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হতো না। এই টাকা অবশ্য সাধারণ মানুষের কাছ থেকেই ওঠাচ্ছে সরকার। বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে পিডিবির ভর্তুকি বেড়ে যাওয়ায়। বিদ্যুৎ নিয়ে ভোক্তারা ত্রিমুখী চাপে আছেন। দায়মুক্তি আইন নামে পরিচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের মাধ্যমে সরকার বিদ্যুৎ খাতে যা ইচ্ছা, তা-ই করছে। বিদ্যুতের দাম বাড়াতে গণশুনানি করতে হয় না। যখন-তখন দাম বাড়ানো যায়। আবার ডলারের দাম বাড়ার পর তার চাপ ভোক্তার ওপর আসে।
বিদ্যুৎ কেনার বিল ডলারে, ক্যাপাসিটি চার্জ (কেন্দ্রভাড়া) ডলারে; টাকার যেন ব্যবহারই নেই! ফলে সব সময়ই বিদ্যুৎকেন্দ্রের একাংশকে অলস বসিয়ে বসিয়ে ভাড়া দিতে হয়। এ ভাড়াও ডলারেই হিসাব হয় এবং ডলারের দাম বাড়লে খরচ বাড়ে।
বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার কথা বলে ডলারে বিদ্যুৎ বিলের চুক্তি করা হয়েছে। এটা আন্তর্জাতিক রীতিও বটে। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রায় ৭০ শতাংশ খরচ হয় আমদানিতে। কোনো কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদেশি ঋণ থাকে। তাই বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিলের হিসাব ডলারে রাখা হয়। এটি না হলে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে আগ্রহী হবে না।
বিদেশি ঋণ ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানিতে করা খরচ পরিশোধে বিল ডলারে ধরা যেতে পারে। আর জমি কেনাসহ স্থানীয় পর্যায়ে অন্যান্য খরচের অংশটুকু টাকায় বিল করা যায়। কিন্তু বেসরকারি খাতের ৯০ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল পুরোটাই ডলারে হিসাব করা হচ্ছে। আর সৌরচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে সবই ডলারে চুক্তি করা হচ্ছে।
বায়ু ও সৌরবিদ্যুৎ কেনায় আবারও ডলারে চুক্তি করতে যাচ্ছে সরকারÑ মর্মে গতকাল শেয়ার বিজে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কোনো ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হবে না। ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ (এনইএনপি) তথা বিদ্যুৎ উৎপাদন নাই, মূল্যও নাই ভিত্তিতে কেন্দ্র তিনটির সঙ্গে চুক্তি করা হবে।] বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে ডলারে ক্রয় চুক্তি করা হয়। কিন্তু এর জন্য বেশি মূল্য দেয়া দুঃখজনক। যথাসম্ভব স্থানীয় মুদ্রায় ক্রয় চুক্তি করা গেলে খরচ অনেক কমবে। সৌরবিদ্যুতের ক্ষেত্রে জমির খরচ অনেক, এটি কেনা হয় টাকায়। জমির ব্যয় যেন ডলারে পরিশোধের যুক্তি নেই। বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে পিডিবির ঘাটতি কমানো হয়। অথচ ক্রয় চুক্তিতে দক্ষতা ও দায়িত্বশীল হলে বিল পরিশোধ করতে হবে স্থানীয় মুদ্রায়। তাই নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে ডলারের পরিবর্তে টাকায় চুক্তি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।