সোহেল রানা: এখনকার শিশুরা বড় হয়ে কী হতে চায়? তাদের স্বপ্ন কী? জানার জন্য কথা বলেছিলাম কয়েকটি বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে। পরিচিত অনেকের কাছেই জানতে চেয়েছি তাদের আশপাশের শিশুদের স্বপ্নের কথা। এবং অবাক হয়ে আবিষ্কার করেছি, আমরা বেশিরভাগ মানুষই জানি না আমাদের সন্তানদের স্বপ্নের কথা! অথবা আমরা জানতে চাই নাÑওরাও স্বপ্ন দেখে, জীবন নিয়ে ওদেরও কোনো স্বপ্ন থাকতে পারে!
‘কী হতে চাও’ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে মোটা দাগে শিশুদের আমরা দুটো ভাগে ভাগ করতে পারি।
এক দলে পড়বে যাদের বাবা-মা শিক্ষিত বা উচ্চশিক্ষিত, আরেক দলে পড়বে তুলনামূলক কম শিক্ষিত বাবা-মায়ের সন্তানরা।
শিক্ষিত বাবা-মায়ের সন্তানরা জানে, তারা কী হতে চায়। অথবা সঠিক করে বললে, তারা জানে তাদের কী হতে হবে; তাদের চাওয়া বা সামর্থ্য বা আগ্রহ এখানে মুখ্য নয়! এই দলের অধিকাংশ শিশুর উত্তর, তারা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়! কেন হতে চাও জানতে চাইলে সহজ স্বীকারোক্তি, ‘বাবা বলেছে’ অথবা ‘মা বলেছে’!
মূলস্রোতের বাইরে এসে সন্তানের চাওয়াকে প্রাধান্য দেওয়া বাবা-মায়ের সংখ্যা আসলেই কম। তাই রক্ত দেখে গা গুলিয়ে ওঠা ছেলেটার চোখ-মুখ শক্ত করে ডাক্তার হওয়ার চেষ্টা করতে হয়, অঙ্কে বিরক্ত ছেলেটার চেষ্টা থাকে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার! আমরা আমাদের চল্লিশ বছর বয়সী পোড় খাওয়া স্বপ্নগুলোকে ১২ বছর বয়সী শিশুর কাঁধে চাপিয়ে নিশ্চিন্তে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি! আর আমাদের স্বপ্নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে অনেকে হতাশ হয়ে পড়ে, বিপথে চলে যায়। একই কারণে প্রতিবছর এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হওয়ার পর পত্রিকার পাতায় আসে কিছু আত্মহত্যার সংবাদ। ঝরে যাওয়া জীবনগুলো জানতেও পারে না, একটা ‘এ প্লাস’ বা পরীক্ষায় ভালো ফল না করার তুলনায় জীবন অনেক বড়! ছোটবেলা থেকেই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য তাদের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় ক্লাসে ফার্স্ট হতে হবে, স্কলারশিপ পেতে হবে, এ প্লাস, গোল্ডেন এ প্লাস পেতে হবে! তাদের কখনো জানতে দেওয়া হয় না, এ প্লাস না পেলেও অনেক বড় কিছু করা যায়। বুঝতে দেওয়া হয় না, জীবনটা অনেক দামি! আমরা জেনেও না জানার ভাণ করি যে, এ প্লাস না পেলেও একজন ভালো ফটোগ্রাফার হওয়া যায়, ভালো সংগীতশিল্পী হওয়া যায়, আরও অনেক কিছু হওয়া যায় যে পেশাগুলোয় সামাজিক স্বীকৃতি ও আর্থিক সচ্ছলতার নিশ্চয়তা আছে।
হতাশ হই স্বপ্নের দীনতা দেখে, হতাশ লাগে যখন দেখি সবাইকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার হতে হবে! কেউ শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখে না! সাংবাদিক, শিল্পী, চিত্রকর, লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখার মতো বিলাসিতার সময় কোথায়! আমি দেখেছি চিত্র পরিচালক হওয়ার প্রচণ্ড ইচ্ছা আর সব গুণ নিয়ে একটা ছেলে বিবিএ পড়ে ৯টা-৫টা অফিস সামলাচ্ছে; স্কুলশিক্ষক হওয়ার ইচ্ছাকে গলা টিপে মেরে একজন ব্যাংকার হচ্ছে!
তুলনামূলক কম শিক্ষিত বাবা-মায়ের সন্তানরা যাদের একটা বড় অংশই গ্রামের, তাদের অধিকাংশেরই নির্দিষ্ট কোনো স্বপ্ন নেই। তাদের চাওয়া, পড়ালেখা শিখে একটা চাকরি করতে হবে। কী চাকরি, কী পড়তে হবে এ ব্যাপারগুলোও তাদের কাছে পরিষ্কার নয়। গ্রামের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের যখন বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগ পছন্দ করতে হয়, তখন পর্যন্ত তাদের ধারণা থাকে না, কোন বিভাগে পড়লে ভবিষ্যতে তারা কী হতে পারবে, কী হতে পারবে না। ছাত্রছাত্রীরা কীভাবে বিভাগ পছন্দ করে, সেটি আরও হতাশাজনক। সাধারণত পড়ালেখায় যারা একটু ভালো, রোল প্রথম দিকে, তারা বিজ্ঞান পড়বে, অবশিষ্টদের ভেতর থেকে যারা অঙ্কে তুলনামূলক ভালো, তারা বাণিজ্য আর বাকিরা মানবিক! দেশের সম্ভবত সব স্কুলেই মানবিক বিভাগ পড়ানো হলেও অনেক স্কুলেই শিক্ষক সংকট বা প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাবে বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগে পড়তে ছাত্রছাত্রীদের নিরুৎসাহিত করার কথাও শোনা যায়।
একজন স্কুলশিক্ষক জানালেন, তিনি যখন জানতে চেয়েছিলেন ‘তোমরা কী হতে চাও’, একটি শ্রেণির প্রত্যেকে বলেছে, তারা ডাক্তার হতে চায়। কেন ডাক্তার হতে চায় প্রশ্নের উত্তরে সবাই তাদের গাইড বই থেকে পড়া ‘জীবনের লক্ষ্য’ রচনা থেকে দু-এক লাইন করে শুনিয়ে দিয়েছে! অর্থাৎ গাইড বইয়ে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে অন্য কোনো পেশার নাম থাকলে তারা সবাই সেটাই হতে চাইতো! সন্তানদের সঙ্গে আমাদের দূরত্বের সুযোগে ওদের স্বপ্ন দেখানোর দায়ভার গাইড বইয়ের ওপর বর্তেছে।
অবাক ব্যাপার হচ্ছে, যাদের সঙ্গেই কথা বলেছি, তাদের কেউই সরকারি কর্মকর্তা হতে চায়নি! আমরা কথায় কথায়, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে সরকারি কর্মকর্তাদের মুণ্ডুপাত করতে অভ্যস্ত! আমাদের নেতিবাচক মানসিকতাই কি পরবর্তী প্রজন্মকে দেশসেবার এ মহান পেশাগুলোর প্রতি নিরুৎসাহিত করছে?
গ্রামের শিশুদের অনেকের মধ্যেই সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ হওয়ার প্রতি আগ্রহ প্রবল; কিন্তু তারা বা তাদের অভিভাবকদের জানা নেই কখন, কীভাবে, কোন শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলে সামরিক ও শৃঙ্খলা বাহিনীর অংশ হওয়া যায়।
অভিভাবকের ইচ্ছার বাইরে একটা শিশু কী হতে চায়, একটু চেষ্টা করলেই আপনি জেনে ফেলতে পারবেন এবং নিশ্চিতভাবে চমৎকৃত হবেন। এখনকার শিশুদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই সাকিব বা মোস্তাফিজ হতে চায়! কারণ তারা নিয়মিত সাকিব-মোস্তাফিজদের টিভি পর্দায় দেখে। ওদের চোখে ক্রিকেটাররা সফল মানুষ। ক্রিকেটার হতে চাওয়া কি কোনো সমস্যা? না, সমস্যা নয়। একটু অন্যভাবে ঘুরিয়ে দেখলে তাদের চোখে ক্রিকেটার ছাড়া অন্যরা সফল নয়, সমস্যাটা এখানে। আমরা আমাদের সন্তানদের সামনে সফল মানুষের উদাহরণ দাঁড় করাতে ব্যর্থ হচ্ছি।
আমরা সফল মানুষ হিসেবে যাদের কথা বলি, যাদের নিয়ে পড়ি তারা সবাই ধরাছোঁয়ার বাইরের স্বপ্ন জগতের মানুষ! আমরা জানি এদের নিয়ে গল্প লেখা হয়, এদের ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, তাই তাদের সাফল্যের গল্প আমাদের নাড়া দেয় না, অনুপ্রাণিতও করে না। সফল মানুষ কিন্তু আমাদের আশপাশেই আছে, অনেক আছে। কিন্তু তাদের আমরা সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারছি না। আমি একজনকে চিনি, একবেলা ভ্যান চালাতো আর একবেলা পড়ালেখা করতো, আজ সে বড় ডাক্তার! একটা ছেলে কাগজ কেনার টাকা না থাকায় চক দিয়ে বোর্ডে অঙ্ক করত, দিনে একবেলা খেয়ে কলেজ করতো; টিউশনি করে পড়ালেখা করে আজ সে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে বড় চাকরি করে। বাবাহীন নিম্নবৃত্ত ঘরের একটা মেয়ে অভাবের কাছে মাথা নত না করে টিউশনি করে আজ বড় সরকারি কর্মকর্তা, এরকম আরও কত উদাহরণ দেওয়া যাবে! আমি জানি, আপনিও এ রকম অনেককে চেনেন। এরাই হতে পারে আমাদের সন্তানদের ‘রোল মডেল’!
স্বাভাবিকভাবেই জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে গ্রামের ছেলেমেয়েরা অনেক পিছিয়ে আছে। তারপরও তাদের বা তাদের বাবা-মায়ের যে চাওয়াগুলো আছে, পথ জানা নেই সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর। সঠিক পথনির্দেশ দিতে মাধ্যমিক পর্যায়ের বইয়ে কিছু নির্দেশনামূলক অধ্যায় যোগ করা কি খুব কঠিন? বইয়ে এমন কিছু অধ্যায় রাখা যেতে পারে, যেখানে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগ নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা থাকবে। কোন বিভাগে কোন বিষয়গুলো পড়ানো হয়, সেগুলো পড়ে কী হওয়া যাবে, কোন বিভাগে পড়ে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কোন বিষয়ে পড়া যাবে, চাকরির বাজারে তাদের চাহিদা কেমন এ বিষয়গুলোর বিস্তারিত থাকা প্রয়োজন।
স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তক যুগোপযোগী করতে হবে। তুলে নিয়ে আসতে হবে আমাদের আশপাশের সাফল্যের গল্প, অনুপ্রেরণার গল্প। টমাস আলভা এডিসন কতবারের চেষ্টায় বিদ্যুৎ বাতি বানিয়েছেন, তার চেয়ে একজন বেকার ছেলে কীভাবে কম খরচে মুরগির খামার, মাছের চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছে, সেই গল্প জানা আমাদের বেশি জরুরি। প্রয়োজনে আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য সাধারণ শিক্ষার চেয়ে কর্মমুখী শিক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আলাদা শিক্ষাক্রম তৈরি করতে হবে। হাতে-কলমে শিক্ষাকে জনপ্রিয় করতে হবে। কতটুকু পড়ালেখা জানলে, হাতের কাজ জানলে দক্ষ শ্রমিক হয়ে বিদেশ যাওয়া যায়, কী করলে সেনাবাহিনী-পুলিশে চাকরি পাওয়া যায়, এসব বিষয় পাঠ্যক্রমে নিয়ে আসতে হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশ ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ সুবিধার পর্যায়ে আছে। এটি এমন একটি সময়, যখন দেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা (১৫-৫৯ বছর) নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর (১৫ এর কম, ৬০ এর বেশি) তুলনায় বেশি থাকে। দেশে এখন ১০ কোটির বেশি মানুষ কাজ করতে সক্ষম। তাদের কাজ দিতে হবে। চারপাশে অসংখ্য তরুণ তাদের শক্তিশালী হাত নিয়ে প্রস্তুত। তাদের এই হাতকে, মেধাকে ব্যবহার করার সুযোগ করে দিতে হবে। একটি দেশের উন্নতির জন্য এর চেয়ে ভালো সময় আর পাওয়া যাবে না। এ অবস্থা ২০ থেকে ৩০ বছর স্থায়ী হয়; বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২০৩৫-এর কাছাকাছি পর্যন্ত এই সুবিধা থাকবে। এরপর এই জনগোষ্ঠী আর কর্মক্ষম থাকবে না, অবসর জীবনে প্রবেশ করবে। এ সময়ের ভেতর দেশের উন্নতির পাশাপাশি এই মানুষগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতিও নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ সুবিধায় থাকা এ মানুষগুলোকে যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না করা যায়, অবসর জীবনে এরা দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এ বিরাট বোঝা টানার ক্ষমতা আমার গরিব দেশের নেই।
আমরা যদি এগিয়ে যেতে না পারি, বিশ্ব আমাদের জন্য বসে থাকবে না। আমরা যদি পিছিয়ে পড়ি, কেউ আমাদের টেনে তুলবে না। ব্যর্থদের বন্ধু থাকে না। বন্ধু বলি, শত্রু বলি, শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো শুধু নিজেদের সুবিধার জন্যই আমাদের ব্যবহার করবে এবং তার দায়ভারও শুধু আমাদেরই হবে। সেই অবস্থা আমরা মেনে নিতে পারি না, মেনে নেবও না। স্বপ্ন দেখতে হবে, স্বপ্ন দেখার পরিবেশ তৈরি করতে হবে, স্বপ্নের পেছনে ছোটার হাতিয়ারে শান দিতে হবে। বিশ বছর পর দেশটা বদলে যাবে, সে আশায় চুপ করে বসে থাকলেই দেশটা বদলে যাবে না। বিশ বছর পর যারা দেশের মূল চালিকাশক্তির অংশ হবে, তাদের মধ্যে স্বপ্নের বীজ বুনে দিতে হবে এখনই।
ফিন্যান্স অ্যান্ড ট্যাক্স কোঅর্ডিনেটর
স্পিই অয়েল অ্যান্ড গ্যাস
সার্ভিসেস (থাইল্যান্ড) লিমিটেড
sohelrana.ibaÑgmail.com