নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের পুঁজিবাজারে গত সপ্তাহে বড় ধরনের পতন দেখা গেছে। প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ব্যাপক দরপতনের মধ্য দিয়ে কমেছে সবগুলো সূচক। এছাড়া লেনদেন হ্রাসের সঙ্গে সপ্তাহ শেষে বাজার মূলধন কমেছে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে, সপ্তাহজুড়ে বিভিন্ন কারণে বাজারের ওঠানামায় নতুন বিনিয়োগ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েন বিনিয়োগকারীরা। ফলে নতুনভাবে বিনিয়োগ না বাড়িয়ে মূলধন-আমানতের প্রতি মনোযোগী ছিলেন তারা। এসব কারণেই বাজারে পতন দেখা গেছে।
সাপ্তাহিক লেনদেনের চিত্রে দেখা যায়, গত সপ্তাহে ডিএসই’র বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৫১ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা, যা তার আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে ছিল ৫ লাখ ৫৭ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত সপ্তাহে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বাজার মূলধন কমার অর্থ তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার ও ইউনিটের দাম সম্মিলিতভাবে ওই পরিমাণ কমেছে। অর্থাৎ গত সপ্তাহে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করা অর্থের পরিমাণ কমে গেছে।
সমাপ্ত সপ্তাহে পুঁজিবাজারে পতনের পেছনে স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ার একটি বড় অনুঘটক বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এর আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার (৯ ডিসেম্বর) পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি সিদ্ধান্ত নেয়, যেসব কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ৩০ কোটি টাকার কম, তাদের এক বছরের মধ্যে মূলধন এই পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। মূলধন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বোনাস শেয়ার, রাইট শেয়ার বা রিপিট আইপিওর পরামর্শ দেয় বিএসইসি। আর এই খবরে রোববার যাচাই-বাছাই ছাড়া দাম বাড়তে থাকে স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ারের। এসব কোম্পানির মধ্যে বহুগুলো লোকসানি, বছরের পর বছর লভ্যাংশ দিতে পারেনি। কোনো কোনোটির উৎপাদন বন্ধ, ঋণে জর্জর। কিন্তু দাম বাড়ে প্রায় সবগুলোর। কিন্তু একটি বিষয় বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। সেটি হলোÑপরপর তিন বছর মুনাফায় না থাকলে রিপিট আইপিও করা যাবে না, রিজার্ভ টাকা না থাকলেও বোনাস ও রাইটও দেয়া যাবে না।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদের একটি বক্তব্যও লেনদেনের পর বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্রভাব ফেলে। তিনি জানিয়েছেন, তারা কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে প্রস্তাব চাইবেন, যারা কোম্পানি পুনর্গঠন করার মতো অবস্থায় না, তাদের এসএমই বোর্ডে নিয়ে যাওয়া হবে। সেই বোর্ডে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা লেনদেন করতে পারেন না। এসএমই বোর্ডে এখন পর্যন্ত ছয়টি কোম্পানি আছে। মূল বাজারের সঙ্গে তুলনা করলে সেখানকার কোম্পানিগুলোর শেয়ারগুলো এত বেশি নয়। নতুন তালিকাভুক্ত দুটি কোম্পানি তিন মাসের মধ্যেই অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে গেছে। এই অবস্থায় ওই সপ্তাহের দ্বিতীয় দিনেই কিছুটা ‘হুঁশ ফেরে’ বিনিয়োগকারীদের। আর এই প্রক্রিয়ায় আগের দিন বেশি দরে যারা শেয়ার কিনেছিলেন, তারা এক দিনেই লোকসানে পড়েন। এরপর থেকেই বিনিয়োগ নিয়ে সতর্ক অবস্থানে চলে যান বিনিয়োগকারীরা। নতুন বিনিয়োগ না করে শেয়ার বিক্রি করে আমানত সংগ্রহের প্রতি বেশি মনোযোগী হতে দেখা যায়। এর প্রভাবে সপ্তাহের চার কার্যদিবসের মধ্যে একদিন বাদে সবদিনেই পতন হয়েছে ডিএসইতে।
গত সপ্তাহে বাজার মূলধন কমার পাশাপাশি যে কয়টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বেড়েছে প্রায় তার চারগুণ প্রতিষ্ঠানের দরপতন হয়েছে। সপ্তাহজুড়ে লেনদেনে অংশ নেয়া ৭৫টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বেড়েছে। এর বিপরীতে দাম কমেছে ২৯৭টির। অন্যদিকে দর ধরে রাখতে পেরেছে মাত্র ৮টি কোম্পানি।
এতে গত সপ্তাহে ডিএসই’র প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স কমেছে ১১৬ দশমিক ৫৭ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আগের সপ্তাহে সূচকটি বেড়েছিল ৪৮ দশমিক ৫৪ পয়েন্ট বা দশমিক ৭০ শতাংশ। প্রধান মূল্যসূচকের পাশাপাশি কমেছে ইসলামি শরিয়াহ ভিত্তিতে পরিচালিত কোম্পানি নিয়ে গঠিত শরিয়াহ সূচক ডিএসইএস। সপ্তাহজুড়ে সূচকটি কমেছে ১৩ দশমিক ১৬ পয়েন্ট বা দশমিক ৮৯ শতাংশ। অন্যদিকে, বাছাই করা ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত ব্ল–-চিপ সূচক বা ডিএস৩০ কমেছে ৪৫ দশমিক ৭৩ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
গত সপ্তাহের প্রতি কার্যদিবসে ডিএসইতে গড়ে লেনদেন হয়েছে ৯৩৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে প্রতি কার্যদিবসে গড় লেনদেন হয় এক হাজার ৬১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কার্যদিবসে গড় লেনদেন কমেছে ১২৮ কোটি ৫৩ লাখ টাকা বা ১২ দশমিক ১০ শতাংশ। সপ্তাহজুড়ে মোট লেনদেন হয়েছে ৩ হাজার ৭৩৩ কোটি ৮ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে এটি ছিল ৫ হাজার ৩০৯ কোটি ১ লাখ টাকা। সেই হিসাবে লেনদেন কমেছে এক হাজার ৫৭৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকা বা ২৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ। অবশ্য বিজয় দিবসের দিনে ডিএসইর লেনদেন বন্ধ থাকায় মোট লেনদেন বেশি হারে কমেছে।
বিদায়ী ডিএসই’র খাতভিত্তিক লেনদেনের শীর্ষে রয়েছে ব্যাংক খাত। মোট লেনদেনের ১৬ দশমিক ৭ শতাংশই এ খাতের অবদান। এছাড়া ১১ দশমিক ৭ শতাংশ লেনদেন করে ফার্মা খাত দ্বিতীয় ও ৯ দশমিক ৯ শতাংশ লেনদেন করে তালিকার তৃতীয় স্থানে রয়েছে বিবিধ খাত। এছাড়া বস্ত্র, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, খাদ্য প্রকৌশল ইত্যাদি খাতগুলোর লেনদেন ভালো ছিল।
টাকার অঙ্কে সব থেকে বেশি লেনদেন হয়েছে ওয়ান ব্যাংকের শেয়ার। সপ্তাহজুড়ে ব্যাংকটির শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২৯১ কোটি ৬২ লাখ ২২ হাজার টাকা, যা মোট লেনদেনের ৭ দশমিক ৮১ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বেক্সিমকোর শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২৮৩ কোটি ৯৮ লাখ ৪ হাজার টাকার। ১৬৯ কোটি ৮৪ লাখ ৩৭ হাজার টাকা লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে ছিল ফরচুন শুজ।