কাজী সালমা সুলতানা: ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ। বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এদিন বিকালে পল্টন ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিশাল ছাত্র-জনসভায় ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ পাঠ করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইশতেহার।
এর আগে ২ মার্চ রাতেই ইকবাল হলে নিউক্লিয়াসের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় কী কী বিষয় নিয়ে ইশতেহার রচিত হবে। স্বাধীনতার ইশতেহার প্রণয়নের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের কাজটি করেন সিরাজুল আলম খান। তোফায়েল আহমেদের রুমে সিরাজুল আলম খান ও ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি আব্দুর রউফ তিন ঘণ্টা ধরে ইশতেহারের খসড়া তৈরি করেন। উপস্থিত থাকেন আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ। ইশতেহারের খসড়া চূড়ান্ত হলে নিউক্লিয়াস তা অনুমোদন করে। ভোরের আগেই পাঁচ হাজার কপি ছাপা হয়ে যায়। প্রচারপত্রটির শিরোনাম ছিল ‘স্বাধীনতার ইশতেহার; জয়বাংলা।
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজকে স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই বিকালে পল্টনে ছাত্রলীগ সভাপতি নুরে আলম সিদ্দীকির সভাপতিত্বে ছাত্রসমাজ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সভায় স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হলো। তার পড়া শেষ হলে পল্টনে আকস্মিকভাবেই সেখানে উপস্থিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। পরে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ইশতেহারটি আবার পড়ে শোনান।
এ ইশতেহারে বলা হয়, ৫৪ হাজার ৫০৬ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগোলিক এলাকার সাত কোটি মানুষের জন্য আবাসভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ। ইশতেহারে আরও বলা হয়;
এই দেশ গঠন করে নিন্মলিখিত তিনটি লক্ষ্য অর্জন করতে হবে
১. স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে পৃথিবীর বুকে একটি বলিষ্ঠ বাঙালি জাতি সৃষ্টি এবং বাঙালির ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি বিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
২. স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে অঞ্চলে অঞ্চলে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য নিরসনকল্পে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করে কৃষক-শ্রমিক রাজনীতি কায়েম করতে হবে।
৩. স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে ব্যক্তি, বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ নির্ভেজাল গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে।
এছাড়া বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার জন্য গ্রহণ করতে হবে নিন্ম লিখিত কর্মপন্থা
১. বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম, মহল্লা, থানা, মহকুমা শহর ও জেলায় স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটি গঠন করতে হবে।
২. সব শ্রেণির জনসাধারণের সহযোগিতা কামনা ও তাদের ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।
৩. শ্রমিক এলাকায় শ্রমিক ও গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের সুসংগঠিত করে গ্রামে গ্রামে, এলাকায় এলাকায় মুক্তিবাহিনী গঠন করতে হবে।
৪. হিন্দু-মুসলমান ও বাঙালি-অবাঙালি সাম্প্রদায়িক মনোভাব পরিহার এবং সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে।
৫. স্বাধীনতা সংগ্রামকে সুশৃঙ্খলার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা এবং লুটতরাজসহ সব ধরনের সমাজবিরোধী ও হিংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে।
ঘোষিত স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারা
১. বর্তমান সরকারকে বিদেশি উপনিবেশবাদী শোষক সরকার গণ্য করে এর ঘোষিত সব আইনকে বেআইনি বিবেচনা করতে হবে।
২. তথাকথিত পাকিস্তানের স্বার্থের তল্পিবাহী পশ্চিমা অবাঙালি মিলিটারিকে বিদেশি ও হামলাকারী শত্রুসৈন্য হিসেবে গণ্য এবং এ হামলাকারী শত্রুসৈন্যকে খতম করতে হবে।
৩. বর্তমান বিদেশি উপনিবেশবাদী শোষক সরকারকে সব ধরনের ট্যাক্স-খাজনা দেয়া বন্ধ করতে হবে।
৪. স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণরত যেকোনো শক্তিকে প্রতিরোধ, প্রতিহত, পাল্টা আক্রমণ ও খতম করার জন্য সব ধরনের সশস্ত্র প্রস্তুতি নিতে হবে।
৫. বৈজ্ঞানিক ও গণমুখী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সব ধরনের সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।
৬. কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
৭. শোষক রাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তানি দ্রব্য বর্জন এবং সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
৮. উপনিবেশবাদী পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে হবে।
৯. স্বাধীনতা সংগ্রামরত বীর সেনানীদের সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ুন।
একই সঙ্গে সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন আন্দোলনের এ পর্যায়ে ‘স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ, দীর্ঘজীবী হউক’, ‘স্বাধীন কর স্বাধীন কর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘স্বাধীন বাংলার মহান নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’, ‘গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়, মুক্তিবাহিনী গঠন কর’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘মুক্তি যদি পেতে চাও, বাঙালিরা এক হও।’ ইশতেহারটি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিপুল করতালির মধ্যে তা গৃহীত হলে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে পল্টন ও পার্শ্ববর্তী এলাকা।
ঢাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে ওই দিন পাকিস্তান সরকার জারি করে সান্ধ্য আইন। সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করেই ঢাকায় অব্যাহত থাকে জনতার বিক্ষোভ ও মিছিল। এদিনও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ঢাকায় দ্বিতীয় দিনের মতো এবং সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। সারাদেশে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণ ও বিভিন্ন ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তি নিহত হন। ঢাকা ছাড়াও রংপুর ও সিলেটেও কারফিউ জারি করা হয়।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১০ মার্চ ঢাকায় নেতাদের সম্মেলনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। ঘোষণায় তিনি বলেন, সম্মেলনের পর দুই সপ্তাহের মধ্যে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়ার আমন্ত্রণ তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। ভুট্টোর উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, গণতান্ত্রিক নিয়ম প্রণীত এক শাসনতন্ত্র যদি না চান, তাহলে আপনাদের শাসনতন্ত্র আপনারা রচনা করুন। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করব।