Print Date & Time : 6 September 2025 Saturday 10:18 am

স্বাধীন স্বাধীন দিকে দিকে

কাজী সালমা সুলতানা: ১২ ডিসেম্বর, ১৯৭১। জামালপুর থেকে পালিয়ে আসা কিছু শত্রুসৈন্য ও ময়মনসিংহ থেকে বিতাড়িত  পাকসেনারা টাঙ্গাইলে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মিত্রবাহিনী টাঙ্গাইলের মির্জাপুর, কালিয়াকৈর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সেনা নামিয়ে দেয়। রাতে টাঙ্গাইলের ওপর আক্রমণ চালায় মিত্রবাহিনী। তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে কাদেরিয়া  বাহিনী। তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। দিন রাত যুদ্ধ শেষে পাক হানাদারেরা অস্ত্র সমর্পণ করে।

মিত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক জেনারেল অরোরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভর ঢাকা মুক্ত করার জন্য যৌথ বাহিনীকে নির্দেশ দেন। 

ঢাকা সেনানিবাসে নিরাপদ আশ্রয়ে বসে জেনারেল নিয়াজী বলেন, একটি প্রাণ জীবিত থাকা পর্যন্ত প্রতি ইঞ্চি জায়গার জন্য আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাব। রাতে প্রাদেশিক সরকারের বেসামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী আলবদর ও আলশামসের কেন্দ্রীয় অধিনায়কদের ডেকে পাঠান সদর দপ্তরে। সেদিন  বৈঠকে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করা হয়। মেজর জেনারেল রাও ফরমান বুদ্ধিজীবীসহ বিশেষ বিশেষ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের নামের তালিকা তুলে দেন।

নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন অত্যন্ত কঠোর ভাষায় ভারতকে পাকিস্তান ছেড়ে যেতে বলেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মাতৃভূমি রক্ষায় শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। তিনি ঘোষণা করেন, কোনো শক্তি নেই পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে পারে। রাতে আলবদর বাহিনী এপিআই’র জেনারেল ম্যানেজার সাংবাদিক নিজামউদ্দিন আহমেদ, আ ন ম গোলাম মোস্তফাকে তাদের বাসভবন থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। তারা আর ফিরে আসেননি। পাক হানাদার বাহিনীর দোসরদের হাতে তারা শহিদ হন।  

মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনীর পরাজয় সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে তাদের মিত্র সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।

এদিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার বলেন, ‘আগামীকাল ভারতকে অবশ্যই যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য করা হবে। অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’

১২ ডিসেম্বর যুদ্ধবিরতি ঘোষণার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা দীর্ঘ বক্তব্য দেয়ার পর ওই অধিবেশন মুলতবি হয়ে যায়। দি নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দাও শরন সিং বলেন, পূর্ব বাংলার কোনো ভূমি দখলের কোনো লোভ ভারতের নেই।

ভারতীয় নৌ বাহিনী সপ্তম নৌবহরের আসন্ন তৎপরতা বিঘœত করার জন্য চালনা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ছোট বড় সব জাহাজ ও নৌযান উপকূলীয় অবকাঠামো, কক্সবাজার বিমানবন্দর প্রভৃতি ধ্বংস করে ফেলে। 

 এদিন দিনাজপুরের বিরল থানার বহলা গ্রাামে পাক হানাদার বাহিনী এক নৃশংস গণহত্যা চালায়। ১২ ডিসেম্বর বহলা গ্রামে গ্রামবাসীকে একত্রিত করে। অনেকে মাগরিবের নামাজ পড়ার জন্য নামাজের কাতারে দাঁড়ান। সবাই যখন নামাজের কাতারে তখন পিছন দিক থেকে ব্রাশ ফায়ার করে পাক হানাদার বাহিনী। তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলে শহিদ হন ৩৭ জন।

এদিন নীলফামারী, গাইবান্ধা, নরসিংদী, সরিষাবাড়ি, ভেড়ামারা ও শ্রীপুর পাকিস্তান হানাদারমুক্ত হয়।

তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর , মূলধারা ’৭১ ও ’৭১-এর দশ মাস