Print Date & Time : 10 July 2025 Thursday 11:17 pm

স্বাধীন স্বাধীন দিকে দিকে

কাজী সালমা সুলতানা: ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১। এদিন মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর অগ্রবর্তী দল শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী অতিক্রম করে ঢাকার প্রায় পাঁচ মাইলের মধ্যে পৌঁছে যায়। বালু নদীর পূর্ব দিকে পাকিস্তানি শত্রুবাহিনী নিজস্ব অবস্থান ঘিরে এক সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে।

যৌথবাহিনী ঢাকার পতন দ্রুততর করার লক্ষ্যে যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন করে, কারণ ঢাকার পতন হলে আনুষ্ঠানিকভাবে পাক বাহিনীর পরাজয় চূড়ান্ত হবে।

মিত্রবাহিনী ঢাকার প্রায় ১৫ মাইলের মধ্যে পৌঁছে যায়। এদিন রাত ৯টায় ভারতের মেজর জেনারেল নাগরা টাঙ্গাইলে আসেন। ব্রিগেডিয়ার ক্লে ও ব্রিগেডিয়ার সান সিং সন্ধ্যা থেকে টাঙ্গাইলে অবস্থান করছিলেন। রাত সাড়ে ৯টায় টাঙ্গাইল ওয়াপদা রেস্ট হাউসে তারা পরবর্তী যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনায় বসেন। আলোচনার শুরুতে মেজর জেনারেল নাগরা মুক্তিবাহিনীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা যদি আমাদের বিনা বাধায় এতটা পথ পাড়ি দিতে সাহায্য না করতেন, তাহলে আমাদের বাহিনী দীর্ঘ রাস্তায় যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ত। রাস্তাতেই আমাদের অনেক শক্তি ক্ষয় হয়ে যেত।’

উত্তরাঞ্চলে যৌথবাহিনী দুপুরে গোবিন্দগঞ্জ থেকে ঢাকা মহাসড়ক ধরে বগুড়ার উদ্দেশে রওনা হয়। বগুড়ায় তখন শত্রুবাহিনীর একটি রেজিমেন্ট কামান ও ট্যাংকসহ অবস্থান করছিল। রাতে যৌথবাহিনী চারদিক থেকে বগুড়া শহর ঘিরে ফেলে। মধ্যরাতে যৌথবাহিনীর তিনটি ব্যাটালিয়ন উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব-উত্তর দিক থেকে শত্রুর ওপর আঘাত হানে।

এদিন সৈয়দপুরে আত্মসমর্পণ করে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়কসহ ১০৭ পাকিস্তানি শত্রু সেনা। চতুর্থ বেঙ্গল চট্টগ্রামের দিকে এগোনোর পথে নাজিরহাটে  হানাদার বাহিনী বাধা দেয়। এখানে ব্যাপক যুদ্ধের পর শত্রুবাহিনী পালিয়ে যায়। এদিকে বাংলাদেশের নিয়মিত বাহিনীর সর্বপ্রথম ইউনিট হিসেবে ২০ইবি ঢাকার শীতলক্ষ্যার পূর্বপাড়ে পৌঁছায়।

এদিকে শান্তি কমিটি ডা. মালিক মন্ত্রিসভা ও স্বাধীনতাবিরোধী দালালরা বেশিরভাগই অবস্থা বেগতিক দেখে গা ঢাকা দেয়। তবে এর মধ্যেও ঘাতক আলবদর চক্র সক্রিয় ছিল।

এ দিনে সাংবাদিক সেলিনা পারভীনকে তার সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় কিছু আলবদর কর্মী। পরে তাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। পরে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। তিনি সাপ্তাহিক বেগম, সাপ্তাহিক ললনা ও শিলালিপি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। এদিনও পাক সেনারা ৫৮ নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে।

এদিন নিরাপত্তা পরিষদের মুলতবি বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব সোভিয়েত ভোটের মুখে বাতিল হয়ে যায়। ২৪ ঘণ্টা নিশ্চল রাখার পর সপ্তম নৌবহরকে আবার সচল করা হয় বঙ্গোপসাগরের দিকে। ইসলামাবাদে বারবার সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ইসলামাবাদ থেকে সামরিক কর্তারা ঢাকায় অবস্থানরত ঘাতকদের আশ্বস্ত করেন যে, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য সেদিন আর আসেনি।

বৃহত্তর রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ ১৬ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হলেও সামগ্রিকভাবে রাজশাহী মুক্ত হয় ১৮ ডিসেম্বর। এদিন পাক হানাদার, রাজাকার ও আলবদরদের পরাজিত করে কালেক্টরেট ভবনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে পাবনাকে শত্রুমুক্ত বলে ঘোষণা দেন বীর যোদ্ধারা। ‘জয় বাংলা’ সেøাগান দিয়ে শুরু হয় বিজয় মিছিল।

তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও মূলধারা ৭১