কাজী সালমা সুলতানা: বৃহত্তর রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ ১৬ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হলেও নাটোরে পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে ১৮ ডিসেম্বর পাক হানাদারমুক্ত হয় রাজশাহী।
পাকিস্তানি হানাদারেরা চার হাজার নিরীহ মানুষকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমিতে নির্মমভাবে হত্যা করে। সেখানকার নারীরাও তাদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হল, জেলখানা ও বিভিন্ন বন্দিশালা থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে নির্যাতিত মানুষেরা। রাজশাহীর মাদ্রাসা মাঠে স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলেন লাল গোলা সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী।
এদিন রাজবাড়ী পাকিস্তানিদের দখল থেকে মুক্ত হয়। বিহারি, পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা এক হয়ে যুদ্ধে বাঙালিদের হত্যায় অংশ নেয়। ১৬ তারিখ দেশ স্বাধীন হলেও রাজবাড়ী বিহারি ও রাজকারদের দখলে থাকায় এবং তারা আত্মসমর্পণ না করায় রাজবাড়ী মুক্ত হতে দেরি হয়।
পাক হানাদার, রাজাকার ও আলবদরদের পরাজিত করে কালেক্টরেট ভবনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তলনের মাধ্যমে পাবনা শত্রুমুক্ত হয়েছে বলে ঘোষণা দেন বীর যোদ্ধারা। সেখানে পাক সেনারা ৫৮ নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে আক্রমণ চালিয়ে সৈয়দপুরকে শত্রুমুক্ত করে।
এদিকে মিত্রবাহিনীর বিমানকে স্বাগত জানাতে সবাই অপেক্ষা করতে থাকেন। বাংলাদেশ সরকারের দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নবনিযুক্ত মহাসচিব রুহুল কুদ্দুস ও পুলিশের আইজি আবদুল খালেক ঢাকা এসে পৌঁছান। সারা ঢাকা শহরে কিছুক্ষণ পরপরই গুলির শব্দ শোনা অব্যাহত ছিল।
প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে পাঠানো এক খোলা চিঠিতে প্রখ্যাত ফরাসি লেখক ও বুদ্ধিজীবী আন্দ্রে ম্যালর ভারতের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র সমালোচনা করেন এবং বাংলাদেশের যৌক্তিকতা সমর্থন করেন। তিনি বাংলাদেশের পক্ষে সরব ছিলেন। বাংলাদেশের পক্ষে তার লড়াইয়ের প্রতিশ্রুতি জানিয়ে তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ১৫০ অফিসার তার সঙ্গে লড়তে প্রস্তুত ছিল।
এদিন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে চারটি রুশনির্মিত ট্যাংক মোতায়েন করা হয়। এই হোটেলে আশ্রয় নেয়া সাবেক গর্ভনর ডা. এএম মালিককে মুক্তিযোদ্ধারা ছিনিয়ে নিতে পারে বলে মনে করে এই প্রহরা বসানো হয়।
সানডে টাইমসের সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পাকিস্তানকে অবশ্যই মুজিবকে মুক্তি দিতে হবে।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। বেলা ২টা ৩০ মিনিটে পশ্চিম রণাঙ্গণেও যুদ্ধবিরতি ঘটে। যুদ্ধবিরতির জন্য ভারতের একতরফা প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে বলে ঘোষণা করেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। দুই সপ্তাহ দুই ঘণ্টা স্থায়ী যুদ্ধে পাকিস্তানের ৯৪টি যুদ্ধবিমান, ২১৪টি ট্যাংক ও ২২টি নৌযান ভারতীয় সৈন্যদের হাতে ধ্বংস হয়। আগের রাতে পিকিংয়ের ভোজসভায় চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাই ভারতীয় ‘আগ্রাসন’ সমর্থন করার জন্য রাশিয়াকে অভিযুক্ত করেন। এর প্রতিবাদে রুশ রাষ্ট্রদূত ভোজসভা ত্যাগ করেন।
মীরপুরের বধ্যভূমিতে খুঁজে পাওয়া নিহত স্বজনের শতাধিক লাশ বিজয় আনন্দে উদ্বেল দেশবাসীর মনে বিষাদের ছায়া ফেলে। এসব শহীদের কাতারে ছিলেন বাংলার বুদ্ধিজীবীরা।
এদিন নিলফামারীর হিমকুমারী ক্যাম্পে বীর যোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে আক্রমণ চালিয়ে সৈয়দপুর শত্রুমুক্ত করে। উল্লেখ্য, অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে সৈয়দপুরে বিহারি ও পাক সেনারা সাধারণ বাঙালিদের ওপর বেশ কয়েকবার হামলা করে।
২৫ মার্চ কালরাতে ১৫০ প্রভাবশালী মানুষকে সৈয়দপুর সেনানিবাসে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের মধ্যে গণপরিষদ সদস্য ডা. জিকরুল হক ছিলেন। ১৯ দিন অমানবিক শারীরিক নির্যাতনের পরে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামারুজ্জামান মুজিবনগরে বলেন, ‘আমাদের রক্তস্নাত দেশে লাখো উৎপীড়িত মা-বোনদেরও যুদ্ধবীরের সম্মানে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। বাংলাদেশ সরকার সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কর্মস্থলে যোগদানের নির্দেশ দেয়। ১৮ ডিসেম্বর পিন্ডিতে সরকারের মুখপাত্র বলেন, মুজিবের বিচার শেষ, তবে রায় এখনও দেয়া হয়নি। সারা পৃথিবীর রাষ্ট্রপ্রধানদের কণ্ঠে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়ার দাবি ওঠে।
তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও ৭১-এর দশ মাস