Print Date & Time : 21 July 2025 Monday 11:40 pm

স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সুব্যবস্থা চাই

আতিয়া ফাইরুজ ঐশী: মানুষ মরণশীল, এটি একটি চিরন্তন বাস্তবতা। আজ হোক বা কাল হোক, যেকোনো সময় সবাইকে এই ক্ষণস্থায়ী জগৎ ছেড়ে বিদায় নিতে হবে। কিন্তু পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে কেইবা যেতে চায়? বেঁচে থাকার ইচ্ছা সবার মাঝেই আছে; আর শুধু বেঁচে থাকা নয়, বরং প্রতিটি মানুষ চায় একটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন। তাই সামান্য বা বিশাল যেকোনো অসুস্থতাতেই মানুষ স্রষ্টার পরে নির্ভর করে সেবাকেন্দ্রগুলোর ওপর। শরণাপন্ন হয় চিকিৎসকদের। কিন্তু মানুষের আস্থাতীত সেবাকেন্দ্রগুলোই যদি হয়ে ওঠে অনাস্থার উৎস, তবে তার দায় কে নেবে?

বর্তমানের স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রগুলো মানুষের আস্থার চেয়ে অনাস্থাই যেন অধিক হারে কুড়িয়ে নিচ্ছে। শহর ও গ্রামাঞ্চলের চিকিৎসা সেবাকেন্দ্রগুলোর অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পরিবেশ সম্পর্কে সমালোচনা করার জন্য কষ্ট করে বিশেষ পর্যবেক্ষণ করার প্রয়োজন হয় না। জেলা শহরের বিভিন্ন হাসপাতালের বাইরের অবস্থা দেখলে মনে হয় যেন হাসপাতাল নয়, বরং ভাগাড়। হাসপাতালের স্যালাইনের প্যাকেট, রক্তের প্যাকেট, অপারেশনের সুচ, বিভিন্ন সার্জিকাল এক্সেসরিজ, ডিসপোজাল সিরিঞ্জ, গজ, ব্যান্ডেজ, হাসপাতালের পচা-বাসি খাবার, তাছাড়া হাসপাতাল কর্তৃক ব্যবহƒত বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় বর্জিতাংশ হাসপাতালের বাইরেই জমিয়ে এক স্তূপ বানানো হয়। এই স্তূপ দেখে মনে হয় যেন এটি হাসপাতালেরই একটি অংশ এবং এটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কিন্তু আসলেই কি এটা কোনো হাসপাতালের পরিবেশ! হাসপাতাল অসংখ্য মানুষ যায় সুস্থতার আশায়। সেক্ষেত্রে হাসপাতালের পরিবেশই যদি থাকে এমন অস্বাস্থ্যকর, তাহলে রোগীর সুস্থ হওয়া অস্বাভাবিক এবং সুস্থ মানুষের অসুস্থ হওয়াটা স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। আবার বলতে গেলে ধরা হবে বাড়াবাড়ি, কিন্তু আজকাল তো কিছু বস্তু তার নির্ধারিত স্থানেও পাওয়া যাচ্ছে না; যেমন কবরে পাওয়া যায় না কঙ্কাল, হাসপাতালে পাওয়া যায় না বেড। যে শিশু জন্মের পর থাকার কথা তার মায়ের কোলে, সে শিশুই নাকি জন্মের পরে হাসপাতাল থেকেই হয়ে যায় চুরি। উন্নতি প্রযুক্তির সুবাদে যতই সিসিটিভি ফুটেজে চোর ধরা পড়–ক না কেন, এসব ঘটনা তো কোনো কালেই কাক্সিক্ষত নয়।

এবার আসি অভ্যন্তরীণ অবস্থায়। আজকাল মানুষের জীবনের চেয়ে অর্থ অধিক মূল্যবান, আর হওয়াটাও স্বাভাবিক, কারণ একটা জীবন শেষ হওয়া মানেই তো পৃথিবীর বুক থেকে একটা বোঝা কমে যাওয়া, আর কাগজের অর্থের ওজন তো খুব হালকা, তাই এর অবস্থান পৃথিবীর বুকে অতটা ভারী নয়। সুতরাং মানুষের জীবন থাকুক বা না থাকুক, টাকার অস্তিত্ব থাকা আবশ্যক। এজন্যই তো টাকার অভাবে বহু মানুষ হারাচ্ছে তাদের মূল্যবান জীবন, আবার অনেকে হারাচ্ছে তাদের আপনজন। প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোয় রোগীদের যতটা সেবা-শুশ্রƒষা দেখা যায়, সরকারি ক্লিনিকগুলোতে দেখা যায় তার অর্ধেক। এর মানে এই না যে সরকার খামখেয়ালিপনা করছে; বরং সরকারি হাসপাতালগুলোয় সেবা প্রদানের জন্য সরকারিভাবে যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ করা হয় ঠিকই, কিন্তু উদাসীনতা দেখা যায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। ৭০০ টাকার বাতির মূল্য যদি চার হাজার টাকা লেখা হয়, তবে উন্নয়ন হবে কীভাবে? রোগীদের পর্যাপ্ত সেবা প্রদানেও দেখা মেলে অনীহার। রোগী বেডে পড়ে থাকে, কিন্তু সময়ে সময়ে পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণ পায় না। অনেক সময় হাসপাতালের অনেক সেবিকা ও কর্মীদের আচরণও থাকে ভদ্রতার প্রতিকূলে, ফলে তাদের কাছে কিছু জিজ্ঞাসা করতেও রোগীরা ইতস্ততবোধ করে। আবার অনেক হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ, বাথরুম প্রভৃতি থাকে নোংরা অবস্থায়, যা রোগীদের জন্য অস্বাস্থ্যকর। তবে এ ব্যাপারে শুধু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দোষারোপ করলে পক্ষপাতিত্ব হয়ে যাবে, কারণ হাসপাতালের বাথরুম ও অন্যান্য পরিবেশ নোংরা করার ক্ষেত্রে সাধারণত রোগী ও তার সঙ্গে আসা স্বজনরাই বিশাল একটি ভূমিকা পালন করে।

আবার প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোয় দেখা যায়, টাকার খেলা অর্থাৎ যাদের টাকা যত বেশি, তাদের জীবনের মূল্যও তত বেশি। প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোয় চিকিৎসাসেবার মান যত ভালো, তার পেছনে অর্থও ঢালতে হয় ঠিক সেই পরিমাণেই, যা একটি মধ্যবিত্তের পক্ষেই সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। আর নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও দরিদ্রদের কথা তো তুলে ধরাই অবান্তর। তাহলে বলা যায়, প্রাইভেট হাসপাতালে যেতে হলে অসুস্থ হওয়ার আগে ধনী হতে হবে, আর তা যদি না হওয়া যায় তবে আত্মাকে দেহত্যাগ করতে বলতে হবেÑব্যাপারটা প্রকৃতপক্ষে এমনই দাঁড়ায়।

আবার অনেক সময় রোগীর পেটের ভেতর গজ, ছুরি ইত্যাদি রেখেই পেট সেলাই করে ফেলার মতো অপ্রত্যাশিত ও ভয়ানক ঘটনাগুলোর কথাও আজকাল শোনা যাচ্ছে। ফলে অনেক চিকিৎসকের ভুল ও অপচিকিৎসার জের বর্তায় সাধারণ মানুষ। আবার কিছু ডাক্তারের ভিজিটিং ফি শুনলে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়ে যায়।

সুতরাং মূল ব্যাপার এখানে চিকিৎসক, সরকারি বা প্রাইভেট ক্লিনিক প্রভৃতি নয়; বরং মূল ব্যাপার হচ্ছে মানুষের সেবা। করোনার সাগরে বয়ে চলা অসহায় এই বিশ্বের বর্তমান আশ্রয়স্থল চিকিৎসকদের দ্বীপেই। প্রায় দুই বছর ধরে প্রবহমান করোনা মহামারিতে মানুষকে মানুষ ভাবতে শিখিয়েছেন চিকিৎসকরা। তারা তাদের নিজ জীবনের পরোয়া না করে মানবসেবার কাজে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছে এবং এখনও রাখছেন। চিকিৎসকরা যদি নিঃস্বার্থভাবে কাজ না করতেন, চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো যদি মানবসেবার কুঠিরে পরিণত না হতো, তবে করোনা যতদূর মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে তার এক-চতুর্থাংশও হতো কি না, তা প্রশ্নবিদ্ধ। অসংখ্য চিকিৎসক এই মহামারিতে তাদের প্রাণ হারিয়েছেন মানবসেবায় নিয়োজিত থেকে এবং অবশ্যই তারা আছেন আমাদের হƒদয়ের চিরশ্রদ্ধার আসনে। তারা চাইলে হয়তো পারতেন নিজেদের আড়াল করে ‘নিজে বাঁচলে বাবার নাম’ প্রবাদটিকে স্পষ্ট বাস্তবতায় রূপান্তর করতে, কিন্তু তারা তা করেননি। তারা অদম্য সাহসের সঙ্গে নিয়োজিত ছিলেন মানবসেবার কাজে এবং তারা এখনও তাই করে যাচ্ছেন।

ডাক্তারি পড়া কোনো সহজ ব্যাপার নয়। ডাক্তারি পড়া মানে স্রষ্টার সৃষ্টিকুলের শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ নিয়ে গবেষণা করা, যা সবার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। আর আজকাল একজন ডাক্তারকে লেখাপড়ার পেছনে যতটা শ্রম দিতে হয়, ঠিক সে পরিমাণ অর্থও তাকে ব্যয় করতে হয়। সুতরাং একজন ডাক্তার তার পড়ালেখার পেছনে যতটা অর্থ ব্যয় করেছেন, সেটির প্রতিদান আশা করার অধিকার কি তার নেই, অবশ্যই আছে। আর নিজের পেটে লাথি দিয়ে মানবসেবা করা, এটা আবার কোন শাস্ত্রের কথা! সুতরাং চিকিৎসকদের ভিজিটিং ফি নেয়ার ক্ষেত্রে সীমারেখা রাখতে হবে। সাধারণ মানুষের পেটের কথা যেমন চিকিৎসকদের ভাবতে হবে, ঠিক তেমনি সাধারণ মানুষেরও চিকিৎসকদের শ্রমের মূল্যায়ন করতে হবে। চিকিৎসকের কাজ যদি মানবসেবাই হয়, তবে চিকিৎসকের সেবা কে করবে? চিকিৎসক যেমন জনগণের কথা ভাববে, ঠিক তেমনি জনগণকেও চিকিৎসকদের কথা ভাবতে হবে।

আর যেখানে আসে চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর ব্যাপার, সেক্ষেত্রে বলা যায়, মানুষ অসুস্থ অবস্থায় নিজের বাড়িতে থেকে যতটা স্বস্তি অনুভব না করে, তার চেয়ে হয়তো বেশি স্বস্তি পায় চিকিৎসা কেন্দ্রে গিয়ে। তাই চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোকে মানুষের সামর্থ্যরে অনুকূলে রাখতে হবে। প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর পরিবেশ ও সেবার মান তুলনামূলকভাবে বেশি ভালো হয় এবং ভালোটা পেতে হলে অবশ্যই ব্যয় একটু বেশি করতেই হবে। কিন্তু সেই ব্যয় মধ্যবিত্তের সামর্থ্যরে চেয়ে দুই-চারগুণ বেশি হলে মানা যায়, কিন্তু দশগুণ বেশি হওয়া তো উচিত নয়। তাই সে বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সচেষ্ট হতে হবে। আর সরকারি হাসপাতালগুলোর পরিবেশ ও সেবার মান আরও উন্নত করতে হবে। সরকার তার পক্ষ থেকে হাসপাতালগুলোর মানোন্নয়নের জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করছে, তাই সরকারিভাবে প্রদত্ত অর্থের যথাযথ ব্যবহার করতে হবে। এখনও অনেক সরকারি হাসপাতাল আছে, যার সেবার মান যথেষ্ট উন্নত। তাই যেখানে কিছু হাসপাতাল যখন সেবার মান উন্নত রাখতে পারে, সেখানে সব হাসপাতাল কেন পারবে না, অবশ্যই পারবে। সরকারের পক্ষ থেকে এককভাবে চেষ্টা করলেই যদি সব সম্ভব হতো, তাহলে জনমত ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা বলে কোনো বিষয়ই থাকত না। তাই জনসেবার ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আরও সচেষ্ট হতে হবে।

হাসপাতাল মানেই সেবার কেন্দ্র, আর এই সেবাকেন্দ্রগুলোকে অন্তত শাস্তিকেন্দ্রে পরিণত না করে শান্তিকেন্দ্রে পরিণত করার চেষ্টাই কাম্য। স্রষ্টার পরে মানুষ অসুস্থ অবস্থায় সুস্থতার জন্য চিকিৎসকের ওপরই আস্থা রাখে। আর চিকিৎসাকেন্দ্রগুলো হচ্ছে মানুষের সেবার একটি স্থান, যা হতে হবে মানুষের জন্য উপযোগী। সুতরাং চিকিৎসা ব্যবস্থাকে উন্নত করার লক্ষ্যে সচেতনতা কাম্য। একটি দেশের উন্নয়নে চিকিৎসা ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশ, যেটি অসংখ্য চড়াই-উতরাই পার করে বর্তমানে একটি উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর হয়েছে, সে দেশটি একটি উন্নত দেশের খ্যাতি পাওয়ার ক্ষেত্রে কেন পিছিয়ে থাকবে? বাংলাদেশকে আমরা বিশ্বের বুকে একটি উন্নত দেশ হিসেবে দেখতে চাই, যার জন্য সম্মিলিত প্রয়াস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

শিক্ষার্থী

শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়