Print Date & Time : 11 September 2025 Thursday 2:52 am

স্বাস্থ্য খাতের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন জরুরি

 

ইসমাইল জাবিউল্লাহ: এ যাবৎ পর্যন্ত যত মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে স্বাস্থ্য অধিকার অন্যতম। অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাস্থ্যকে অন্যতম মানবিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক বিল অব রাইট হিসেবে পরিচিত ‘টহরাবৎংধষ উবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ ঐঁসধহ জরমযঃং (টউঐজ)’ ১৯৪৮ স্বাস্থ্যসেবাকে অন্যতম মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ‘অনুচ্ছেদ ২৫’-এ স্বাস্থ্যকে পর্যাপ্ত জীবনযাত্রার অধিকারের অংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের মৌলিক নীতিতেও স্বাস্থ্যের অধিকার স্বীকৃত।

বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যর উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন।’

‘জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১’-তে স্বাস্থ্যকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাস্থ্যসেবাকে অন্যতম মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সেসব কনভেনশন অনুমোদন করছে। স্বভাবতই ওই সব কনভেনশন বিধান মানতে বাধ্য।

আমরা এর আগে স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপক অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা লক্ষ করেছি। গত করোনার সময় চিকিৎসা ব্যবস্থা পুরো নাজেহাল হয়ে গিয়েছিল। অনেক বেশি সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়েছিল। বিশেষ করে সরকারি মেডিকেল হাসপাতালগুলোয় অবস্থা নাজেহাল ছিল। প্রয়োজনের তুলনায় ডাক্তার, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও অবকাঠামো অপ্রতুল। ফলে চিকিৎসাপ্রত্যাশীরা প্রত্যাশিত সেবা পাচ্ছেন না।

এছাড়া বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রকাশ পেয়েছে। ফলে যেখানে সারাবিশ্বে চিকিৎসা ব্যাপক সফলতা পাচ্ছে, সেখানে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি, যে কারণে প্রতিবছর দেশের বড় একটা জনগোষ্ঠী উন্নত চিকিৎসার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশে চলে যায়। কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে ভারতে এক বাংলাদেশি নাগরিক চিকিৎসা করাতে গিয়ে ওখানকার স্থানীয় কয়েকজন যুবক দ্বারা হেনস্তার শিকার হয়েছেন। বিদেশে চিকিৎসা করাতে যাওয়া এসব মানুষকে মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হয়, সেই সঙ্গে দেশের টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। এতে অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সরকারি হাসপাতালের বেয়ারা থেকে শুরু করে কতিপয় ডাক্তার, কর্মকর্তা ও কর্মচারী অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। কিছুদিন আগে খোদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাপপাতালে ভুয়া নারী চিকিৎসক দিনের পর দিন চেম্বার খুলে বসেছেন, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, যা সত্যিই দুঃখজনক।

গত বছর এক রিট আবেদনের শুনানিকালে হাইকোর্টে একটি বেঞ্চের দুই বিচারপতি বলেন, ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজশে অনেক চিকিৎসক মুনাফা করছেন।

ওই বিচারপতির মন্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ নেই বলেই মনে করি। কতিপয় চিকিৎসক নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে প্রেসক্রিপশন দিয়ে তাদের কোম্পানির অতিরিক্ত ওষুধ গ্রহণের সুপারিশ করেন। আবার অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা করার নির্দেশ দেন। ফলে রোগীকে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়।

এছাড়া প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা হাসপাতালে হাসপাতালে রোগীদের হাত থেকে প্রেসক্রিপশন কেড়ে নেন। এরপর স্মার্টফোন দিয়ে ছবি তুলে নিয়ে নিশ্চিত হন নিয়োগদাতা কোম্পানির ওষুধ চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে লিখেছেন কি না। এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু এসব উদ্যোগ বিশাল এ জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত নয়।

খুব দেরি হলেও এখনই আরও বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। যেমনÑস্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়াতে হবে এবং বাজেটের অর্থ যথাযথ কাজে ব্যাবহার হচ্ছে কি না, সেটার তদারকি করতে হবে। ঢাকা আসার প্রবণতা হ্রাস করতে প্রতিটি জেলার সদর হাসপাতাল, উপজেলা হাসপাতাল এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিকে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সার্বক্ষণিক ডাক্তারের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। যে যে হাসপাতালের অবকাঠামোগত উন্নয়ন জরুরি, সেগুলোর উন্নয়ন করতে হবে এবং পর্যাপ্ত বেড নিশ্চিত করতে হবে।

যেসব ডাক্তার সেবা প্রদান করবেন, তাদের আবাসন থেকে শুরু করে পর্যাপ্ত বেতন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। বিশেষ করে যথাযথ মূল্যায়নের অভাবে দেশের চিকিৎসাশাস্ত্রপড়ুয়া বড় একটা অংশ বিসিএস, ব্যাংকসহ অন্যান্য সরকারি চাকরির পরীক্ষার দিকে মনোনিবেশ করছেন এবং অনেকে পড়াশোনা শেষে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন এবং সেখানেই স্থায়ী হচ্ছেন, যেটা দেশের চিকিৎসা খাতের জন্য ভালো লক্ষণ নয়। এতে রাষ্ট্রের অনেক অর্থ অপচয় হচ্ছে, সেই সঙ্গে জনসাধারণ প্রত্যাশিত চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই ডাক্তারদের অবস্থান অনুযায়ী ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সব মেডিকেল সরঞ্জাম ক্রয় করতে হবে। যেসব হাসপাতালে সরঞ্জাম আছে, কিন্তু অকার্যকর, সেগুলো ঠিক করে ব্যবহারের উপযোগী করতে হবে। যারা চিকিৎসা বিষয়ে জ্ঞান রাখেন, তাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব দিতে হবে।

সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগে টিকিট কাটার বুথ বাড়াতে হবে, যাতে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়। প্রয়োজনীয় পরীক্ষার রিপোর্ট স্বল্প সময়ের মধ্যে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ডাক্তারের কিংবা কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে রোগী মারা গেলে প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ভর্তি করা রোগীদের পুষ্টিযুক্ত প্রয়োজনীয় খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। স্বজনপ্রীতি রোধে নজরদারি বাড়াতে হবে। হাসপাতাল এলাকায় দালালদের প্রতিহত করতে হবে। প্রয়োজনে আইন তৈরি করে দালালদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

এছাড়া স্বাস্থ্য খাতে গবেষণা বাড়ানোর জন্য বাজেট বৃদ্ধি করার পাশাপাশি এ বিষয়ে দক্ষ ব্যক্তিদের উৎসাহিত করতে হবে। ‘জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০১১’ পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সব ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে।

এ ছাড়া বিনা খরচে কিংবা যৌক্তিক খরচে রোগী পরিবহনের (ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস) ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। দেশের প্রাইভেট হাসপাতালগুলোকে একটা নীতিমালায় নিয়ে আসতে হবে।

দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিতে সুস্থ জনসম্পদের মানুষের বিকল্প নেই। তাই সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই বাংলাদেশ বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চিকিৎসা খাতে উন্নতির দিকে যাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না এবং মানুষ দেশের হাসপাতালের প্রতি আস্থা ফিরে পাবে।

শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ,জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়