রেজাউল করিম খোকন: বাঙালি উৎসব ও আনন্দপ্রিয় জাতি। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নানা উপলক্ষে তারা আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে। সেসবের মধ্যে ব্যতিক্রমী হয়ে আবির্ভূত হয় বাংলা নববর্ষ, যার স্বাদ, গন্ধ ও আবেদন অন্যান্য উৎসব থেকে একেবারেই আলাদা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ, সব বাঙালি সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সমগ্র জাতি একই হƒদয়াবেগে একটি মোহনায় মিলিত হয়ে পালন করে এই সর্বজনীন উৎসব। চিরায়ত বাঙালিত্বের অহংকার আর সংস্কৃতির উদার আহ্বানে জাগরূক হয়ে নাচে-গানে, গল্পে-আড্ডায় ও আহারে-বিহারে চলে নতুন বছরকে বরণ করার পালা। বাংলা নববর্ষ তাই বাঙালিদের জীবনে সবচেয়ে বড় সর্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক উৎসব। এর মাধ্যমে জাতি তার স্বকীয়তা ও জাতীয়তাবাদী চেতনার শক্তি সঞ্চয় করে; সচেষ্ট হয় আত্মপরিচয় ও শিকড়ের সন্ধানে। এরূপ নববর্ষই বাঙালি জাতিকে ইস্পাতকঠিন ঐক্যে আবদ্ধ করেছিল, শক্তি ও সাহসের সঞ্চার করে স্বাধিকার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রেরণা জুগিয়েছিল। কবিগুরুর ভাষায়Ñ‘নব আনন্দে জাগো আজি নব রবির কিরণে শুভসুন্দর প্রীতি উজ্জ্বল নির্মল জীবনে। অমৃত পুষ্প গন্ধ বহ শান্তি পবনে দেহে-মনে নির্ভেজাল আনন্দ উপভোগে।’ নববর্ষ বিদায়ী বছরের গ্লানি মুছে দিয়ে বাঙালি জীবনে ওড়ায় নতুনের কেতন, চেতনায় বাজায় মহামিলনের সুর। সব ভেদাভেদ ভুলে সব বাঙালিকে দাঁড় করায় এক সম্প্রীতির মোহনায়। নববর্ষের আগমনী ধ্বনি শুনলেই সমগ্র জাতি নতুনের আহ্বানে জেগে ওঠে। গ্রামের জীর্ণ-কুটির থেকে বিলাসবহুল ভবন কিংবা দূর প্রবাসের মেগাসিটিÑসর্বত্রই প্রবাহিত হয় আনন্দের ফল্গ–ধারা। আবহমান বাংলার চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনার মূলে রয়েছে এক অসাধারণ অনুষঙ্গ, সেটি হলো বাংলা নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ। ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় বাংলা বর্ষবিদায় ও বরণের অনুষ্ঠানমালা তাই আমাদের সেই ঐতিহাসিক চেতনাকে প্রোজ্জ্বল করে।
স্বদেশ মানস রচনায় বাঙালি সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ঐতিহ্য সর্বোপরি ইতিহাসের আলোকে রক্ষণশীল ও পশ্চাৎপদ চিন্তা-চেতনাকে পরিহার করে আধুনিক ও প্রাগ্রসর অভিধায় জাতিসত্তাকে যথাযথ প্রতিভাত করার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি বাংলা নববর্ষকে দান করেছে অনবদ্য মাঙ্গলিক যাত্রাপথ। তবে বাঙালির নববর্ষ সব বাঙালির কাছে একভাবে আসেনি। কারও কাছে এসেছে খরা হয়ে, কারও কাছে খাজনা দেয়ার সময় হিসেবে, কারও কাছে বকেয়া আদায়ের হালখাতা হিসেবে, কারও কাছে মহাজনের সুদরূপে আবার, কারও কাছে এসেছে উৎসব হিসেবে। উল্লেখ্য, হিজরি সনকে উপেক্ষা নয়, বরং হিজরি ৯৬৩ সালকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে শুধু ফসল তোলার সময়কে সৌরবর্ষের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার লক্ষ্যে সূর্যকে মানদণ্ড হিসেবে ধরে সৌরবর্ষ অথবা ফসলি বর্ষ হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সম্রাট আকবরের শাসনকালে সৌরবর্ষ (বঙ্গাব্দ) ও চন্দ্রবর্ষকে (হিজরি) একক মাত্রায় নির্ধারণ করা হয়। সম্রাট আকবরের রাজজ্যোতিষী আমীর ফতেউল্লাহ সিরাজীর সূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশ বিবেচনায় শুভক্ষণ গণনার দিন হিসেবে পহেলা বৈশাখকে নববর্ষ উদ্যাপনের দিন ধার্য করা হয়। বাংলা নববর্ষের উৎপত্তি জানতে হলে আমাদের নিতে হবে ইতিহাসের আশ্রয়। ভারততত্ত্ববিদ আল বিরুনি ‘কিতাব উল হিন্দ’-এ (রচনাকাল আনুমানিক ১৩৩০ খ্রি.) ভারতবর্ষের যেসব অব্দের (শ্রীহর্ষাব্দ, বিক্রমাব্দ শকাব্দ, বলভাব্দ ও গুপ্তাব্দ) নাম উল্লেখ করেছেন, তাতে বঙ্গাব্দ নেই। বঙ্গাব্দ চালু হয় এর অনেক পরে ১৫৫৬ খ্রিষ্টাাব্দে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে। সম্রাট আকবরের রাজজ্যোতিষী আমির ফতেউল্লাহ সিরাজীর প্রচেষ্টায় এই নতুন অব্দের প্রচলন হয়। আকবরের সিংহাসনে আরোহণের ২৫ দিন পর অর্থাৎ বুধবার ২৮ রবিউস সানি (১১ মার্চ) ভুবন আলোককারী নতুন বর্ষের সূচনা হয়েছিল। এই দিনটি ছিল পারসিক বছরের নওরোজ। আবার সৌরবর্ষের চেয়ে চন্দ্রবর্ষ ১০-১২ দিন কম হওয়ার ফলে কৃষকদের কৃষিকাজ-সংক্রান্ত কাজে দিনক্ষণের সঠিক হিসাব রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এই সমস্যার সমাধানে মোগল সম্রাট আকবরের নির্দেশে আবুল ফজল ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ফসলি সনের প্রবর্তন করেন, যা বর্তমানে বাংলা সন হিসেবে প্রচলিত। এতে ৯৬৩ হিজরি সনের মহররম মাসের ১ তারিখ থেকে বৈশাখী সনের প্রথম দিন গণনা শুরু হয়। অর্থাৎ হিজরি ৯৬৩ সনের ১ মহররম এবং ১ বৈশাখ ৯৬৩ একই দিন ছিল। অর্থাৎ হিজরি ৯৬৩ সনের সঙ্গেই বঙ্গাব্দ যুক্ত হতে থাকে। আর চন্দ্রমাসভিত্তিক হিজরি সন ১২-১২ দিন হওয়ায় হিজরি সনের তুলনায় বিগত কয়েকশ বছরে বঙ্গাব্দ বেশ কম। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, বাংলা সন চালুর ভিত্তি হলো হিজরি সন। হিজরি সনের বর্তমান বয়স ১৪৪২ বছর। বাংলা সনও হিজরি সনের মধ্যে ব্যবধান মাত্র ১৪ বছর। এই পার্থক্যের কারণ হলো আরবি মাস কখনো ২৯ দিনে হয়ে থাকে। এই পরিবর্তনের পরও প্রতি চার বছর অন্তর এক দিন লিপইয়ার-এর হেরফের থেকে যায়। এই সমস্যা সমাধানের জন্য বহু ভাষাবিদ ও গবেষক ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে প্রধান করে পাকিস্তান আমলে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সাল থেকে বাংলাদেশে প্রচলিত নতুন ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করা হয়। এতে প্রতি ইংরেজি লিপইয়ার বর্ষের বাংলা ফাল্গ–ন মাসে এক দিন যোগ করে সমস্যাটির বিজ্ঞানসম্মত সমাধান করা হয়।
ধারণা করা হয়, মোগল সম্রাট আকবর পহেলা বৈশাখ থেকে অর্থবছর গণনার প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন মূলত রাজস্ব আহরণ তথা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। পূর্বে চন্দ্রমাসের ভিত্তিতে প্রচলিত হিজরি সন ও সৌরবর্ষ গণনার পদ্ধতি প্রক্রিয়ার মধ্যে সমন্বয় ও সাযুজ্য সাধনের তাৎপর্য ও যৌক্তিকতাকে বিচার-বিশ্লেষণের ভার তিনি তার নবরতœ সভার সবচেয়ে বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ সদস্য মশহুর ইতিহাসবেত্তা আবুল ফজল (১৫৫১-১৬০২) এবং অর্থ ও রাজস্ব-বিষয়ক সদস্য রাজা টোডরমলকে অর্পণ করেছিলেন। তাদের নির্দেশনায় আকবরের রাজজ্যোতিষী ফতেউল্লাহ সিরাজী যে সমন্বিত প্রস্তাব প্রণয়ন করেন, তার ভিত্তিতে ফসলি সন নামে নতুন বর্ষ গণনার রীতি প্রবর্তিত হয় ৫৯৪ হিজরি সনের জুলিয়ান ক্যালেন্ডার মোতাবেক ১৪ এপ্রিল সোমবার। প্রবর্তনের খ্রিষ্টীয় সন ১৫৮৪ হলেও ফসলি সনের প্রবর্তক সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের সন ১৫৫৬ থেকেই এর ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা প্রদান করা হয়। প্রজাদের উৎপাদিত ফসলের ওপর কর বা রাজস্ব আরোপ এবং তা যথাসময়ে যথামৌসুমে সংগ্রহের সুবিধার্থেই মূলত ফসলি সনের প্রবর্তন করা হয়।
১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারতের শাসনক্ষমতা কোম্পানির হাত থেকে খোদ ব্রিটিশ সরকারের হাতে চলে যায়। ওয়েস্ট মিনস্টার পদ্ধতিতে পরিচালিত ভারতে ব্রিটিশ সরকারের প্রথম বাজেট আনুষ্ঠানিকভাবে আইনসভায় পেশ করা হয় ১৮৬০ সালের ৭ এপ্রিল। অর্থবছরের ধারণাটি বাংলা সন অনুযায়ী রাখার পক্ষপাতী ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম অর্থমন্ত্রী জেমস উইলসন (১৮০৫-১৮৬০)। স্বনামধন্য ইকোনমিস্ট পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা, স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বিভাগের সচিব, অর্থ সচিব, ব্রিটিশ আইনসভার প্রভাবশালী সদস্য, ফ্রি ট্রেড আন্দোলনকর্মী ও পেপার কারেন্সি প্রবর্তনের প্রবক্তা ছিলেন জেমস উইলসন। ভারতে ভাইসরয়দের কাউন্সিলে অর্থ-সদস্য (মন্ত্রী সমতুল্য) হিসেবে নিযুক্তি পেয়ে কলকাতায় যোগদান করেন ১৮৫৯ সালের ২৯ নভেম্বর। ইতিহাস সচেতন বিচক্ষণ অর্থনীতিবিদ উইলসন ভারতের আর্থ-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিয়ে ১৮৬০ সালের ৭ এপ্রিল উপস্থাপিত ভারত সরকারের প্রথম বাজেট বক্তৃতাতেই ভারতে আধুনিক আয়কর পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রস্তাব করেন। প্রাচীন ভারতের মনুসংহিতা থেকে রাজস্ব আদায়ের সূত্র উল্লেখ করলেও তিনি মূলত ব্রিটেনের আয়কর আইনের কাঠামোয় এদেশে আয়কর আরোপের রূপরেখা দেন। এপ্রিল মাস থেকে তার দেয়া বাজেট বাস্তবায়ন শুরু হয়ে যায়, যার সঙ্গে সম্রাট আকবরের প্রবর্তিত বাংলা সনের যৌক্তিক সাদৃশ্য উল্লেখযোগ্য। কিন্তু গভীর পরিতাপের বিষয়, ভারতে ব্রিটিশ সরকারের প্রথম অর্থমন্ত্রী ভারতে আধুনিক আয়কর পদ্ধতি প্রবর্তনের মাত্র তিন মাসের মাথায় ডিসেন্ট্রিতে ভুগে ১৮৬০ সালের ১১ আগস্ট কলকাতাতেই মারা যান। পরবর্তী চার বছর বাজেট উপস্থাপন করা হয় যথাক্রমে এপ্রিল, মে ও জুন মাসে। ১৮৬৫ সাল থেকে স্থায়ীভাবে আট বছর ১৩ এপ্রিল থেকে শুরুর বিধানটা কার্যকর হয়।
সম্রাট আকবর বাংলা নববর্ষ প্রচলন করলেও নববর্ষ পালনের ইতিহাস বহু পুরোনো। সর্বপ্রথম নববর্ষ পালিত হয় মেসোপটেমিরায় খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ সালে। খ্রিষ্টীয় নববর্ষ চালু হয় জুলিয়াস সিজারের সময় থেকে। রাশিয়া, চীন, ইরান ও স্পেনে নববর্ষ পালিত হতো ঘটা করে। মুসলিম শাসকদের হাত ধরে ইরানের নওরোজ ভারতবর্ষে আসে। মোগল আমলে খুব জাঁকজমকপূর্ণভাবে নওরোজ উৎসব পালন করা হতো। এই নওরোজ উৎসবেই জাহাঙ্গীরের সঙ্গে নূরজাহানের প্রথম মন দেয়া-নেয়া হয়েছিল। তবে বাংলা নববর্ষ যেভাবেই আসুক না কেন, এখন তা বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। তাই পহেলা বৈশাখ এলেই সব বাঙালির প্রাণ বাংলা নববর্ষ বরণের আনন্দে আপনা-আপনিই নেচে ওঠে। পহেলা বৈশাখ তাই পালিত হয় ব্যক্তিগত, ধর্মীয়, সাম্প্রদায়িক, শ্রেণিগত অবস্থানের ঊর্ধ্বে উঠে ‘মানুষ মানুষের জন্য’Ñএই বিশ্বাসকে সমাজজীবনের সর্বত্রছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। ওয়াহিদুল হক, সনজীদা খাতুন প্রমুখের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তাদের দালালদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রবীন্দ্র জš§শতবর্ষ পালনের সময় থেকে ছায়ানট প্রবর্তনায় রমনার বটমূলে যে পহেলা বৈশাখ শুরু হলো, তা আজ গ্রামবাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে। তবে সামাজিক উৎসব হিসেবে নববর্ষ পালন শুরু হয় উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। পঞ্চাশের দশকে লেখক-শিল্পী-মজলিস ও পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ নববর্ষ উপলক্ষে ঘরোয়াভাবে আবৃত্তি, সংগীতানুষ্ঠান ও সাহিত্যসভার আয়োজন করত। সনজীদা খাতুনসহ অন্যদের উদ্যোগে ছায়ানটের আয়োজনে কবিগুরুর ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গানটি দিয়ে বাংলা বছরের প্রথম দিন সকালে নববর্ষের আবাহন শুরু হয় রমনা অশ্বত্থতলায় ১৯৬৫ সালে। পরবর্তী সময় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদী চেতনার পালে যতই হাওয়া লেগেছে ততই উৎসবমুখর হয়েছে নববর্ষের আয়োজন। পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধকরণসহ সাংস্কৃতিক নানা বিধিনিষেধ আরোপ করার পরও নববর্ষে লাগে নিত্যনতুন উদ্দীপনা। দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার পহেলা বৈশাখকে জাতীয় পার্বণ হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর ছায়ানট ছাড়াও রাজধানীতে ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলা একাডেমি, চারুকলা ইনস্টিটিউট, শিল্পকলা একাডেমি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, নজরুল ইনস্টিটিউট, জাতীয় জাদুঘর, বুলবুল ললিতকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন বাংলা নববর্ষকে মহা উৎসবে পরিণত করেছে। বর্তমানে পল্লীর নিভৃত কুটির হতে শুরু করে গ্রামগঞ্জ, জেলা শহর, বিভাগীয় শহর ও রাজধানী শহরের সর্বত্র উছলে পড়ে বাংলা নববর্ষ পালনের আনন্দ। বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য হলো বাংলা বর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ। আর বাঙালিদের কাছে বাংলা নববর্ষ বরণ হলো একটি প্রাণের উৎসব। বাংলা নববর্ষের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো মঙ্গল শোভাযাত্রা। ইউনেস্কো আমাদের পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবেধের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি প্রদান করে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠা করে নববর্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা ও সাংস্কৃতিক সৌধের ভিত আরও সুদৃঢ় করুক, নববর্ষের উদার আলোয় ও মঙ্গলবার্তায় জাতির ভাগ্যাকাশের সব অন্ধকার দূরীভূত হোক, সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিবাদী অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটুক, একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াকÑএটাই হোক বাঙালির প্রত্যয়।
দীর্ঘ ১৫-১৬ বছর ধরে স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকারের শাসনামলে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতিÑসবকিছুতেই এক ধরনের নৈরাজ্য, লুটপাট, বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম ও দুর্নীতির অবাধ রাজত্ব কায়েম করেছিল। তখন স্বৈরাচারী সরকার বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালি ঐতিহ্য, বাঙালি চেতনা প্রতিষ্ঠার নামে ভণ্ডামি, প্রতারণা ও অহমিকার প্রকাশ ঘটিয়েছিল। নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একমাত্র পরিবেশক দাবি করে বিরোধী দল ও মতাদর্শের মানুষের প্রতি এক ধরনের হিংসাত্মক মনোভাব পোষণ করে নানাভাবে আক্রমণ করা হতো। বাঙালি সংস্কৃতির লালন এবং বাঙালি সংস্কৃতির চর্চার ক্ষেত্রে মূলত তেমন কোনো কাজ হয়নি। শুধু চলেছে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্পের নামে লুটপাট। দলীয়করণের ভয়ংকর রূপ আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গনকে কলুষিত করে তুলেছিল। সবাই সেই স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। চব্বিশের জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন একসময় স্বৈরাচার হটাও আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। ছাত্র-জনতা-কৃষক-শ্রমিক সবাই জেগে উঠেছিল স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে। স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশে এবার নতুন আমেজে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের আয়োজন চলছে। ভিন্ন আবহে শুদ্ধ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী হয়ে এখন সবাই একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছে। তেমন প্রেক্ষাপটে আমাদের সবার প্রত্যাশাÑএবার পুরোনো সব দুঃখ, গ্লানি ও শোক ভুলে স্বৈরাচারের রেখে যাওয়া দুষ্টক্ষত, অনাচার, ব্যভিচার, অসভ্যতা, অহমিকাবোধ, দাম্ভিকতা ছলচাতুরী, প্রতারণার বিচিত্র সব রূপ ত্যাগ করে নতুন প্রাণে উজ্জীবিত হয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। এবার বাংলা নববর্ষে এটাই হোক সবার অঙ্গীকার। এবার স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশে নতুন আমেজে বাংলা নববর্ষ সবার জন্য বয়ে আনুক নতুন স্বপ্ন পূরণের সুযোগ। শুদ্ধ তারুণ্যের জোয়ারে নষ্ট, পচা-গলা রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে সঠিক নিয়মে শুদ্ধাচার অনুসরণ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হোক সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার, সমতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। বৈষম্যহীন শোষণমুক্ত ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হোক।
অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক
