Print Date & Time : 13 August 2025 Wednesday 8:02 am

স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে ক্যাশলেস লেনদেন হোক সর্বজনীন

মিজানুর রহমান: ফুটপাতে হাঁটছি আর কিছু একটা কিনছি এবং পেমেন্ট করছি বাংলা কিউআর কিংবা এমএফএসের মাধ্যমে। কখনও যদি এমন হয়Ñখুবই ক্ষুদ্র জিনিস, কিন্তু প্রয়োজনীয়, সেটা স্ট্রিট ভেন্ডার থেকে শুরু করে হকার্স মার্কেট থেকে কিনে পেমেন্ট করছি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে, তাহলে কত সুবিধা হতো? আর কাঁচাবাজারে গেলে টাকার যে দশা হয়, তাতে নাজেহাল হতে হয়! সেটা আর নাইবা উল্লেখ করলাম। এসব বাজারে যদি পেমেন্ট হতো ডিজিটাল পদ্ধতিতে, তাহলে টাকার স্বাস্থ্যটাও অন্তত ভালো থাকত। কিন্তু এ ডিজিটাল পেমেন্টকে আমরা কি এখনও এতটা সর্বজনীন করে তুলতে পেরেছি? দ্বিধা না রেখেই বলা যায়Ñপারিনি। চেষ্টা ও আগ্রহেরও অনেক কমতি আছে, আর সেটা যদি খুব দ্রুত করতে না পারি, তবে যে আমাদের কাক্সিক্ষত ক্যাশলেস সমাজের দিকে ছুটতে পারব না।

দিন বদলের সনদে যদি বদলাতে না পারি, তবে যে ক্যাশলেস লেনদেন করে স্বপ্নের সমাজ, দেশ কিংবা শহর নির্মাণ অধরাই থেকে যাবে বা আরও বিলম্ব হবে। তবে স্বপ্ন দেখতে অসুবিধা কী? আজ নয় কাল, পরশু কিংবা কোনো একদিন তো হবে! আর এগুলো যখন বাধ্যতামূলক করা হবে, তখন ঠিকই কার্যকর হয়। বাংলাদেশ সরকার এ উদ্দেশ্যে একটি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে যে, ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে শতভাগ ক্যাশলেস সমাজে পরিণত করবে। সেই লক্ষ্যে এগিয়ে চলছে নানা পরিকল্পনা ও কর্মশালা। এজন্যই দরকার উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত পাড়া-মহল্লায় শতভাগ ডিজিটাল লেনদেন নিশ্চিত করা। কেবল কোরবানির পশুর হাট বা উৎসবের কেনাকাটা নিরাপদ করাই ডিজিটাল লেনদেন বা ক্যাশলেস সমাজ গড়ার সত্যিকারের কারণ নয়। যদিও ক্যাশলেস সোসাইটি নির্মাণ করার ক্ষেত্রে শুরুতে অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার থাকে। আর সেগুলোরই এখন মুখোমুখি হতে হচ্ছে। যেমনটি মোবাইল ফোন চালু হওয়ার পরে সবার হাতে যে একটি করে মোবাইল ফোন থাকবে, তা কিন্তু কেউ কল্পনা করিনি। সেজন্য প্রতিটি স্মার্টফোনে আছে ইন্টারনেট, তাই পৃথিবীও উš§ুক্ত। চাইলেই ঘরে বসে লেনদেন করতে পারি, এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে, এক এমএফএস থেকে অন্য কোথাও নিমিষেই ট্রান্সফার করতে পারি। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে এখনও ক্যাশ টাকায় যে লেনদেন হয়, তার চাইতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে খুবই কম। সবার প্রচেষ্টায় এসব সুযোগ-সুবিধা সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া দরকার, তাহলেই ক্যাশলেস সোসাইটির আন্দোলন আরও বেগবান হবে। এর সুমিষ্ট ফল ভোগ করবে এদেশের সব মানুষ, উন্নত শিখরে পৌঁছাবে এ দেশটাই।

আমরা যদি কখনও বিদেশে যাই, তাহলে তো শুধু পেমেন্ট পদ্ধতি নয়, বাধ্যতামূলক ডিজিটাল পদ্ধতির সব স্তরে স্পর্শ করি এবং দেশে এসে সেসব বিষয় নিয়ে গল্পসল্প করি। তাহলে দেশকে ভালবেসে বিদেশের মতোই দেশে এমন লেনদেন করলে ক্ষতি কি? বরং অনেক লাভ। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ম্যাকেঞ্জির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে টাকা ছাপানোর খরচ কল্পনাতীত। কেননা কেবল টাকা ছাপানো এবং এর ব্যবস্থাপনার জন্য বছরে ৯ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। পাঁচ বছর আগেই যদি এমন হয়, তাহলে বলতে হয়, বাংলাদেশে কোনো কিছুর দাম কখনও কমেনি। তাই এখন সেই অঙ্কটা বেলুনের মতো ফুলেফেঁপে নিশ্চয়ই আরও বড় হয়েছে।

উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ক্যাশলেস লেনদেন অতীব জরুরি। এর ধারাবাহিকতায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে এবং কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে এমএফএস প্রোভাইডার, ভিসা, মাস্টার ও আমেরিকান এক্সপ্রেস পেমেন্ট স্কিমের সক্রিয় ভূমিকায় স্মার্ট হাটের যুগে বাংলাদেশ পদার্পণ করেছিল ২০২২ সালে কোরবানির গরুর হাটকে কেন্দ্র করে। প্রথম বছরে অল্প সময়ের নোটিশে নতুন উচ্ছ্বাস ও আগ্রহের নিমিত্তে এ হাটের আবির্ভাবে প্রান্তিক গরু ব্যবসায়ীদের ক্যাশ টাকার সুরক্ষার নতুন উপায় তৈরি হওয়ায় তাদের মাঝে উদ্দীপনা ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তবে সচরাচর লেনদেনের চেয়ে ভিন্ন এবং নতুন এ স্মার্ট হাট নিয়ে অভ্যাসহীনতার কারণে শুরুতে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত এবং ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে তথ্যজ্ঞানের অভাবে অনিশ্চয়তা মনে হলেও এটা যে সুদূরপ্রসারী ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে একটি কার্যকর উপাদান, তা সময়ের ব্যবধানে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ক্যাশলেস লেনদেন অত্যাবশকীয় ব্যাপার। আর সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা উপভোগ করার জন্য হলেও ক্যাশলেস সমাজ প্রয়োজন। এর চেয়েও বেশি প্রয়োজন দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য। টেকসই ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন করে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে এ বছরও লেনদেন হচ্ছে ক্যাশলেস, স্মার্ট হচ্ছে বাংলাদেশÑএই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে স্মার্ট হাট নির্মাণ করা হয় উত্তর সিটি করপোরেশন ও সরকারের একশপ প্রকল্প, এটুআই, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, আইসিটি বিভাগ ও ইউএনডিপির সহযোগিতায়, যা সত্যিই ক্যাশলেস সমাজ গঠনের অঙ্গীকার এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তির শতভাগ কাছাকাছি নেয়ার অভিপ্রায়, যেন অর্থনীতিকে নতুন রূপ দেয়ার একটি চমৎকার উদ্যোগ। এছাড়া কোরবানির গরুর স্মার্ট হাটে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ও ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশন অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের খামারিরা পশু বিক্রি করে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ও আগ্রহ প্রকাশ করে ক্যাশলেস পথের ভবিষ্যৎ সুদৃঢ় করার মনোভাব দেখিয়েছেন। এর পাশাপাশি ডিজিটাল লেনদেনে অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য একটি মেঠোপথ খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা যেন আগামী দিনে গরুর স্মার্ট হাট থেকে শুরু করে শহর-বন্দরে কিংবা গ্রামেগঞ্জে তথাপি পুরো বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার দৃঢ়তা ক্যাশলেস লেনদেনের মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত।

প্রতিবছরই সারাদেশে প্রান্তিক গরু ব্যবসায়ীরা কোরবানিকে কেন্দ্র করে পশু মোটাতাজাকরণ, গ্রামীণ হাটবাজার ও ব্যক্তিমালিকানায় পালিত পশু সংগ্রহ করে ব্যবসার জন্য রাজধানীর বিভিন্ন হাটে, কিংবা তাদের পার্শ্ববর্তী শহরে নিয়ে আসে। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশ বিক্রেতা গরু বিক্রি করে নগদ টাকা সঙ্গে রাখতে নিরাপত্তাহীনতা, ছেঁড়াফাটা জাল টাকার ভয় ও নানারকম ঝক্কি-ঝামেলায় নিপতিত হয়ে বিপাকে পড়ে। শুধু তাই নয়, হাজারো ব্যবসায়ীর মধ্যে কেউ না কেউ মলম পার্টি, চুরি-ছিনতাই, কিংবা বাড়ি ফেরার পথে ডাকাতির সম্মুখীন হয়ে অর্থকড়ি হারায়। কখনও কখনও ব্যবসায়ীদের জীবন বিপন্ন হওয়ার মতো দুর্ঘটনা ঘটে। এখন সেই অনিশ্চয়তা ও দুর্ভাবনা লাঘবে প্রতি বছরই পাশে থাকবে স্মার্ট হাটের ডিজিটাল বুথ। এর ফলে ত্বরান্বিত হবে ক্যাশলেস লেনদেন। আর ক্রেতাদের গরুর হাটে বহন করতে হবে না ক্যাশ টাকা। তদ্রূপ ব্যবসায়ীদের টাকা রাখার যে অনিশ্চয়তা ছিল, তা একেবারেই দূর করবে ডিজিটাল লেনদেনের এ প্ল্যাটফর্ম। চাইলেই যেকোনো পর্যায়ের পশুবিক্রেতা ফান্ড ট্রান্সফার করে নিজের অ্যাকাউন্টে টাকা নিয়ে পশু বিক্রিসহ ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রে স্মার্ট হাটের লেনদেন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২২ সালের ঈদুল আজহা উপলক্ষে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ছয়টি স্মার্ট হাটে প্রায় ৩৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা এবং ২০২৩ সালে ৪৪ কোটি টাকা ক্যাশলেস লেনদেন হয়েছিল। সংশ্লিøষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের স্মার্ট হাটে লেনদেন হয়েছে ৯৬ কোটি টাকা। যদিও পুরো দেশে শত শত কোটি টাকার মার্কেটে এ লেনদেন একদমই নগণ্য, তবুও ক্যাশলেস লেনদেন হওয়ার সম্ভাবনা, নতুন ক্ষেত্র কিংবা প্ল্যাটফর্ম এভাবেই হয়তো একদিন পুরো বাংলাদেশকে ক্যাশলেস লেনদেনের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করবে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, পুরো দেশকে ক্যাশলেস করতে দ্রুত ও সঠিক ভূমিকা রাখতে পারবে পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ব্যাংক।

সম্প্রতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে। আমরা এখন ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির স্বপ্ন দেখছি। আর সেটা সম্ভব করতে হলে আমাদের বিপুল জনগোষ্ঠীর লেনদেনকে ব্যাংকিং চ্যানেলের মধ্যে আনতে হবে। প্রান্তিক থেকে উচ্চবিত্ত তথা সকল স্তরের অর্থনীতিকে একই স্তরে আনতে সহজভাবে কাজটি সম্পাদন করতে পারে ডিজিটাল ব্যাংক। কেননা সব জায়গায় মোবাইল ব্যাংকিং, কিংবা এমএফএস পৌঁছানো সম্ভব নয় বলেই স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য এটি হবে অনন্য উপায় বা মাধ্যম।

সুতরাং পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনপূর্বক স্বপ্নের স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে ‘গ্লোবাল ভিলেজ’-এর অংশ হতে ‘বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষায় গুরুত্বারোপ করে বিদ্যালয়গুলোকে সময়োপযোগী করে ঘরে তুলতে হবে। বর্তমান বিশ্ব চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে। যেখানে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার তথ্য ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার ও ডিজিটাইজেশন। এরই আলোকে ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের লক্ষ্যে যোগ্য মানবসম্পদ গড়ে তুলতে আরও দ্রুত প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশ জনবহুল অথচ ছোট্ট একটি দেশ। এ দেশে রয়েছে ৮০ মিলিয়ন যুবক, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ জনগোষ্ঠীকে দক্ষ করে তুলতে হবে। বিশেষ করে বিদেশগামী নাগরিকদের যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ দিয়ে আরও দক্ষ ও যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাহলে বিশ্বের শ্রমবাজারে বাংলাদেশের চাহিদা বাড়বে এবং বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ বৃদ্ধি পাবে। আর এত স্বপ্ন আর সম্ভাবনা সামনে রেখে যারা নতুন সেবা তৈরি করবে, সরকারের দিক থেকে উচিত হবে তাদের জন্য কিছুটা হলেও নীতি-সহায়তা দেয়া ও নিয়ম শিথিল করা। তাহলেই ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে আমাদের জন্মভূমি।

ব্যাংক কর্মকর্তা ও মুক্ত লেখক

mr.rahman@bankasia-bd.com