Print Date & Time : 19 August 2025 Tuesday 7:09 pm

সড়ক দুর্ঘটনা: জানমাল আর্থিক ক্ষতি ও করণীয়

সীমান্ত প্রধান: সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মহাব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই যানের চাকায় পিষ্ট হচ্ছে মানুষ। বছরে সে সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়। এতে নিঃস্ব হচ্ছে বহু পরিবার, পঙ্গুত্ব বরণ করে সমাজ-সংসারের বোঝা হয়ে বেঁচে আছেন কেউ কেউ! এত কিছুর পরও রোধ করা যাচ্ছে না সড়ক দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতিও কম নয়।

বেসরকারি সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির (এনসিপিএসআরআর) তথ্যমতে, গত জানুয়ারিতে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১৬ জন নিহত ও এক হাজার ১২ জন আহত হন। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ৩৩২ জন নিহত ও ৬৫৪ জন আহত হয়েছিলেন। এছাড়া একটি জাতীয় দৈনিকের নিয়মিত তথ্য থেকে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় দুই হাজার ১৯১ জন নিহত হয়েছেন। তাহলে বছর শেষে এ সংখ্যাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেসে  প্রশ্নের স্বাভাবিক যে উত্তর পাওয়া যাবে, তা আঁতকে ওঠার মতো।

‘নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)’ সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ২০১৪ ও ২০১৫ সালের সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান ভয়াবহ। সংগঠনটির তথ্য  অনুযায়ী ২০১৪ সালে ছয় হাজার ৫৮২ জন নিহত হন। আহত হন ১০ হাজার ৭৭০ জন। ২০১৫ সালে নিহত হন পাঁচ হাজার তিনজন; আহত হন ছয় হাজার ১৯৭ জন।

এছাড়া যাত্রীকল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ছয় হাজার ৫৫ জন নিহত ও ১৫ হাজার ৯১৪ জন আহত হন। গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত হতাহত হয়েছেন ২১ হাজার ৯৬৯ জন। এর মধ্যে হাত, পা বা অন্য কোনো অঙ্গ হারিয়ে পঙ্গু হয়েছেন ৯২৩ জন।

এনসিপিএসআরআরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সারা দেশে ৫১ হাজার ৬৬৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে নিহতের সংখ্যা ৫৭ হাজার ২২৬; আহত হন ৯৩ হাজার ৫০৬ জন। সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ২০১৪ সালে। তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ওই বছর আট হাজার ৭৯৮ জন নিহত ও ১৮ হাজার ১১৩ জন আহত হন।

সংগঠনগুলো সূত্রে যে পরিসংখ্যান মেলে, তা কিন্তু তারা তৈরি করে শুধু গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে। অনেক দুর্ঘটনার খবর কোনো গণমাধ্যমে আসে না। তাহলে সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়েও বেশি এটা বলাই যায়।

অদক্ষ ও অসচেতন চালকের হাতে জীবন বন্ধক রেখেই আমাদের পথ চলতে হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় প্রতিশ্রুতি, উদ্যোগের কথা বলা হয়; কিন্তু সেসব প্রায়ই কথার কথা হিসেবে থেকে যায়। সরকার সেভাবে উদ্যোগ নিচ্ছে না বলেই হয়তো সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না।

কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় সড়ক দুর্ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। একজন মন্ত্রী প্রায়ই বলেন, ‘দুর্ঘটনায় কারও হাত নেই’। আবার দোষী চালকদের ‘ঘাতক’ সম্বোধন করলেও তার আপত্তি। অথচ দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোয় প্রতিদিনই ঝরে যাচ্ছে তরতাজা প্রাণ।

বছর শেষে সড়ক দুর্ঘটনার যে পরিসংখ্যান, তা যেন সড়ক দুর্ঘটনার নয়, কতগুলো মানুষের স্বপ্ন হত্যার পরিসংখ্যান। এটি সাধারণ মানুষকে ভাবাচ্ছে। অনুরূপ ভাবনা কি রাষ্ট্রযন্ত্রকেও ভাবায়?

২০১৫ সালের অক্টোবরে ‘বিশ্ব নিরাপদ সড়ক দিবস’ উপলক্ষে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, বাংলাদেশে এক বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় ২১ হাজারেরও বেশি মানুষ, যার মধ্যে ৩২ শতাংশ পথচারী। এই অনুমিত হিসাব ২০১২ সালের। সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষতি মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) এক দশমিক ছয় শতাংশ।

দুর্ঘটনায় ক্ষতি সংক্রান্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ তথ্য যদি সঠিক হয়, তাহলে আমরা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, সর্বোপরি দেশের সার্বিক অর্থনীতি উন্নতির যে আশা করছি সে আশা তিরোহিত। এগিয়ে আসতে হবে রাষ্ট্রকেই। আমরা মুখে যতই উন্নয়নের কথা বলে তৃপ্তি পাই, সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস করা না গেলে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন সম্ভব নয়। তবে এর জন্য চিহ্নিত করতে হবে কী কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে।

অদক্ষ চালক, অতি বোঝাই ও ওভারটেকিং প্রবণতা, অবিরাম গাড়ি চালনা, ট্রাফিক আইন অমান্য করা, ত্রæটিপূর্ণ যান চলাচলে আইনের প্রয়োগহীনতা, অযান্ত্রিক-অনুমোদনহীন যানের আধিক্য, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক ও সড়কের দুরবস্থার কারণেই মূলত দুর্ঘটনা ঘটছে।

২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনা ৫০  শতাংশ কমিয়ে আনার জন্য দশক ঘোষণা করেছে জাতিসংঘ। এর সঙ্গে একাত্ম হয়ে সপ্তম পাঁচশালা পরিকল্পনায় (২০১৬-২০) বর্তমান সরকার এসডিজিতে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ৫০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এটি অন্ধকারে এক টুকরো আশার আলোর ঝলকানি বলা যেতে পারে।

নিসচা’র প্রধান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেছিলেন, সংগঠনের পক্ষ থেকে বাস্তবসম্মত আইন প্রণয়নের বিষয়ে বিভিন্ন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনারও সুপারিশ করা হয়েছে। এ প্রস্তাব অনুযায়ী আইন প্রণয়ণ এবং তা বাস্তবায়ন করলে সড়ক দুর্ঘটনা কমবে।’

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম, দক্ষিণ এশিয়ায় সপ্তম। এমন বাস্তবতায় সর্বস্তরের মানুষের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছিল সড়ক পরিবহন আইনে চালকের কঠোর শাস্তি নিশ্চিতের। দাবির সঙ্গে একমত ছিলেন সড়ক পরিবহনমন্ত্রীও। এর মাধ্যমে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব বলেও মত দিয়েছিলেন তিনি।

৫৬ বছর পর আইনটি নতুন করে করার উদ্যোগেও চালকের সাজা থাকছে আগের মতো। বিভিন্ন দেশে চালকের কারণে দুর্ঘটনায় কারও মৃত্যু হলে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। আমাদের দেশে তা করা যেতে পারে। এছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ, ফিটনেসবিহীন গাড়ি তুলে নেওয়া এবং প্রশিক্ষিত ও লাইসেন্সধারী চালককে যান চালনার জন্য নিয়োগ দিলে সড়ক দুর্ঘটনা কমবে।

 

কবি, গণমাধ্যমকর্মী

simantaprodhan05Ñgmail.com