হজযাত্রাকে সাশ্রয়ী ও সহজ করুন

টি এম মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ:চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ২৭ জুন (৯ জিলহজ) পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হতে পারে। বাংলাদেশ থেকে যারা চলতি বছর হজে যেতে ইচ্ছুক তাদের চূড়ান্ত নিবন্ধন কাজ চলছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ মঙ্গলবার ছিল হজযাত্রীদের চূড়ান্ত নিবন্ধনের শেষ তারিখ। কিন্তু এ পর্যন্ত বাংলাদেশের লক্ষাধিক কোটার বিপরীতে মাত্র প্রায় ৩৪ হাজারের মতো হজযাত্রী চূড়ান্ত নিবন্ধন করেছেন। তাই ধর্ম মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত নিবন্ধনের সময়সীমা আগামী ৭ মার্চ পর্যন্ত আবারও বড়িয়েছে। অতীতের বছরগুলোর তুলনায় মাত্রতিরিক্ত খরচ বৃদ্ধির কারণে অনেকেই এ বছর হজে যেতে পারছেন না। যা ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে।

সম্প্রতি হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)-এর সাবেক সহসভাপতি ফরিদ আহমেদ মজুমদার একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে বলেছেন, কয়েকটি কারণে হজের খরচ বেড়েছে। সেগুলো হচ্ছে ডলার ও রিয়ালের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধি, মোয়াল্লেম খরচ বৃদ্ধি, মক্কা-মদিনার হোটেল খরচ বৃদ্ধি ও বিমান ভাড়া বৃদ্ধি এবং তিনি আরও বলেছেন, খরচ বৃদ্ধির এই কারণগুলো সব দেশের জন্যই প্রযোজ্য। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ থেকে হজের খরচ সবচেয়ে বেশি। প্রশ্ন হলো খরচ বৃদ্ধি সবার জন্য একই হলেও হজ পালন ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে বেশি কেন?

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সৌদি আরবের সঙ্গে চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশ থেকে এ বছর ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজযাত্রী হজ পালনের সুযোগ পাবেন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৫ হাজার এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ১ লাখ ১২ হাজার ১৯৮ জন হজযাত্রী হজ পালন করতে পারবেন। এবার সরকারিভাবে হজ পালনে খরচ হবে ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৮ টাকা। অন্যদিকে বেসরকারিভাবে এজেন্সির মাধ্যমে হজ পালনে সর্বনি¤œ খরচ হবে ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৮ টাকা। অর্থাৎ এটাই সর্বনি¤œ প্যাকেজ মূল্য। তবে এটা তিন বছর আগের খরচের প্রায় দ্বিগুণ, গত বছরের তুলনায় হজ পালনের খরচ ২৯ শতাংশ বা প্রায় দেড় লাখ টাকা বেড়েছে।

জার্মানির আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের হজযাত্রার খরচের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, এসব দেশের চেয়ে হজযাত্রায় বাংলাদেশিদের বেশি টাকা খরচ করতে হয়। গণমাধ্যমটির দেয়া তথ্য নিচে তুলে ধরা হলো।

ইন্দোনেশিয়া: জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ হওয়ায় ইন্দোনেশিয়া থেকে সবচেয়ে বেশি হজযাত্রী হজ পালনের সুযোগ পায় এবং তাদের হজ পালনের খরচ অনেক কম। গত বছরের ১৪ এপ্রিল দেশটির ধর্মমন্ত্রী ইয়াকুত সলিল জানান, এ বছর ইন্দোনেশিয়া থেকে হজে যেতে জনপ্রতি খরচ হবে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৫৩ বাংলাদেশী টাকা (৩,৯৮,৮৬,০০৯ ইন্দোনেশিয়ান রুপি)। যদিও তাদের জনপ্রতি খরচ হবে ৪ লাখ ৮৮ হাজার ২৬০ টাকা। বাকি টাকা হজ ফান্ড ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি বিপিকেএইচের মাধ্যমে ভর্তুকি দেবে সরকার। ২০১৯ সালে দেশটি তৎকালীন ধর্মমন্ত্রী লুকমান হাকিম দাবি করেছিলেন, আসিয়ান দেশগুলোর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া থেকে হজে যেতে একজন মুসল্লিকে সবচেয়ে কম টাকা খরচ করতে হয়।

মালয়েশিয়া: গত বছরের ২২ এপ্রিল দেশটির সরকার হজ পালনের খরচ ঘোষণা করা হয়। বি৪০ গ্রুপের (যে পরিবারের মাসিক আয় ৯৬ হাজার টাকার কম) হজযাত্রীদের জন্য ২ লাখ ১৮ হাজার ৭৫৪ টাকা। আর যেসব পরিবারের মাসিক আয় এর চেয়ে বেশি তাদের খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৫৮ হাজার ৬০০ টাকা। মালয়েশিয়ার ধর্ম বিভাগের মন্ত্রী ইদ্রিস আহমাদ সম্প্রতি জানিয়েছেন, প্রতি বছর হজে ভর্তুকি হিসেবে সরকার ৬০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকা খরচ করে থাকে।

ভারত: আনন্দবাজার পত্রিকা ২০২০ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে হজে যেতে জনপ্রতি খরচ হয়েছিল প্রায় ৩ লাখ বাংলাদেশি টাকা। তবে ওই সময় পশ্চিমবঙ্গ হজ কমিটি ২০২১ সালের হজের খরচ অনেক বাড়িয়ে ৪ লাখ ২৩ হাজার ৫৭১ টাকা নির্ধারণ করেছিল। আর এ বছর এখন পর্যন্ত হজের চূড়ান্ত খরচের হিসাব জানানো হয়নি। তবে ২০১৮ সাল থেকে ভারতে হজের ভর্তুকি বন্ধ করে দেয়া হয়।

পাকিস্তান: দেশটির সরকার এখন পর্যন্ত চলতি বছরের হজের খরচ চূড়ান্ত করেনি। তবে পাকিস্তান ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মুহাম্মদ উমর বাট গত কিছুদিন আগে জানান, এবার হজযাত্রীদের জনপ্রতি খরচ ৩ লাখ ১১ হাজার ৭৪২ বাংলাদেশী টাকা থেকে বেড়ে সাড়ে ৪ লাখ বাংলাদেশী টাকা হতে পারে।

এসব তথ্য থেকে সহজেই বোঝা যায়, বাংলাদেশ ছাড়া ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তান থেকে হজের খরচ অনেক কম। সবচেয়ে কম ইন্দোনেশিয়া থেকে। অর্থনৈতিকভাবে সংকটে থাকা পাকিস্তানেরও হজের খরচ বাংলাদেশ থেকে কম। প্রতিবেশী দেশ ভারতের হজযাত্রীদের খরচও বাংলাদেশ থেকে কম, ২০১৮ সাল থেকে ভর্তুকি বন্ধ করে দেয়ার পরেও। তারা যদি কম খরচে হজ সেবা প্রদান করতে পারে, আমরা কেন পারব না? এ বিষয়টি নিয়ে নীতিনির্ধারকদের কাজ করা উচিত। গত বছর আমাদের দেশের হজযাত্রীদের জন্য বিমান ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা, এ বছর তা মাত্রতিরিক্তভাবে বাড়িয়ে ১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা করা হয়েছে। এসব বিষয় নজর দেয়া প্রয়োজন।

ইসলামের পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভের একটি হচ্ছে হজ। সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জীবনে একবার হজ করা ফরজ। এদেশের মুসলমানরা সারা জীবন সঞ্চয় করেন জীবনে একবার হলেও হজে যাওয়ার জন্য। কিন্তু মাত্রতিরিক্ত খরচের কারণে হজযাত্রা এখন এদেশের মুসলমানদের জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে। হাবের সাবেক সহসভাপতি ফরিদ আহমেদ মজুমদার আরও জানান, এ বছর হয়তো প্রাথমিক নিবন্ধনধারী পেছনের সারির হজগমনেচ্ছুদের দ্বারা কোটা হয়তো পূরণ হয়ে যাবে। কিন্তু এভাবে খরচ বৃদ্ধি পেতে থাকলে সামনের বছরে এসে হজযাত্রী সংকট দেখা দেবে। তাই বিষয়টি নিয়ে সরকারের কাজ করা উচিত। হজের খরচ কমিয়ে হজযাত্রাকে সাশ্রয়ী ও সহজ করা সময়ের দাবি।

          মুক্ত লেখক