হলুদ ট্যাক্সি ক্যাব: অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল শেষে ব্যক্তিগত গাড়িতে রূপান্তর

ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরের সড়ক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ট্যাক্সি ক্যাব। বছর দশেক আগে নগরের রাস্তায় প্রচুর ট্যাক্সি ক্যাব দেখা গেলেও এখন আর চোখেই পড়ে না তেমন। অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ার চালুর পর ভাড়ার ব্যবধানের কারণে এই সেবা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেনি। ২০২৩ সালের পর শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা হলুদ ট্যাক্সি ক্যাবের চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে ট্যাক্সি ক্যাব হিসেবে অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল শেষ হওয়া গাড়িগুলো নিবন্ধন বদলে ব্যক্তিগত গাড়িতে রূপান্তর হয়ে সড়কে চলছে। তবে বিআরটিএ সূত্র জানিয়েছে, পুনরায় ট্যাক্সি ক্যাব সেবা চালুর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে খসড়া গাইনলাইনও করা হয়েছে। এতে সেবা এলাকার পরিধি বাড়ানো হয়েছে।

বিআরটিএ ও ট্যাক্সি ক্যাব পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সূত্রে জানা গেছে, ২০০২ সালের শেষের দিকে ঢাকায় ট্যাক্সি ক্যাব চালু হয়। প্রথম অবস্থায় কালো ও হলুদ রঙের ১১ হাজার ২৬০টি ট্যক্সি ক্যাব নামানো হয়। পরবর্তী সময় আরও ৬ হাজারের মতো ট্যাক্সি ক্যাব নামানোর কথা ছিল। সেসময় আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন নামিদামি প্রতিষ্ঠান অর্থায়ন করে এতে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে নানা কারণে সার্ভিসটি হারিয়ে যায়। তবে ২০১৪ সালের এপ্রিল থেকে ‘তমা কনস্ট্রাকশন’ ও ‘ট্রাস্ট ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসেস’ নামের দুটি কোম্পানিকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ট্যাক্সি ক্যাব নামানোর অনুমতি দেয় সরকার। এ সময় তমা সার্ভিসের ২৫০টি এবং ট্রাস্টের ১৭৫টি ট্যাক্সি রাস্তায় নামায়। ট্রাস্টের ১৭৫টি ট্যাক্সির মধ্যে প্রথমে ঢাকায় ১০০টি ও চট্টগ্রামে ৫০টি চালু করা হয়। পরবর্তী সময় ঢাকায় আরও ২৫টি এবং চট্টগ্রামের ৫০টি ঢাকায় নিয়ে আসা হয়।

সূত্র জানায়, এ দুটি কোম্পানি সড়কে যে ৪২৫টি হলুদ ট্যাক্সি ক্যাব নামিয়েছিল, সেগুলোর ৪০০টির অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। এগুলোর নিবন্ধন বদলে ব্যক্তিগত গাড়িতে রূপান্তর হয়েছে। ট্যাক্সি ক্যাব হিসেবে গাড়িগুলোর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কোম্পানি সেগুলোকে ব্যক্তিগত গাড়িতে রূপান্তর করছে। ট্যাক্সি ক্যাব গাইডলাইনে এ সুযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস জানান, দুটি কোম্পানিকে ট্যাক্সি ক্যাব পরিচালনার জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। সেসব ট্যাক্সি ক্যাবের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেছে, সেগুলো আর সড়কের চলাচল করে না। তবে পুনরায় ট্যাক্সি ক্যাব সেবা চালুর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। ইতোমধ্যে খসড়া গাইডলাইনও করা হয়েছে। এতে সেবা এলাকার পরিধি বাড়ানো হয়েছে।

জানা গেছে, ট্যাক্সি ক্যাব গাইডলাইন-২০১০ অনুযায়ী, ১৫০০ সিসির ট্যাক্সি ক্যাবের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ১০ বছর, ২০০০ সিসির ঊর্ধ্বে হলে ১২ বছর। হলুদ ট্যাক্সি ক্যাবগুলোর সবই ছিল ১৫০০ সিসির। সে অনুযায়ী, প্রায় ৪০০ গাড়ির অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়েছে। তবে করোনার সময় চলাচল বন্ধ থাকায় কোম্পানির অনুরোধে সড়কে চলার মেয়াদ এক থেকে দুই বছর বাড়ানো হয়।

এদিকে গাইডলাইনে বলা হয়েছে, ‘ট্যাক্সি ক্যাবের মেয়াদ শেষে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নির্ধারিত শুল্ক এবং প্রযোজ্য অন্যান্য কর পরিশোধ করে ট্যাক্সি ক্যাবকে ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তরের অনুমতি দেয়ার বিষয় বিবেচনা করা হবে। তবে বিক্রীত গাড়ি কোনো অবস্থায়ই আর ট্যাক্সি ক্যাব হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।

ট্যাক্সি ক্যাব হিসেবে ওই গাড়িগুলোর রেজিস্ট্রেশন ছিল ‘প’ শ্রেণির। বিআরটিএতে এখন মেয়াদ শেষ হওয়া গাড়িগুলোর নিবন্ধন করা হচ্ছে ‘গ’ শ্রেণিতে।

বিআরটিএর সূত্র জানায়, তমা কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড কোং লিমিটেড ৬৫০টি ট্যাক্সি ক্যাব চালানোর অনুমোদন নিলেও সড়কে নামিয়েছিল ২৫০টি। সবক’টির মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় কোম্পানিটি এগুলোকে ব্যক্তিগত গাড়িতে রূপান্তর করেছে। আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টও ৬৫০টি ট্যাক্সি ক্যাব আমদানির অনুমতি নিয়ে সড়কে নামিয়েছিল ১৭৫টি। এর মধ্যে ১৫০টির মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। বাকি ২৫টির মেয়াদ আছে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। মেয়াদোত্তীর্ণ ১৫০টির মধ্যে ৫৭টির কনভার্সন (রূপান্তর) করার জন্য কাস্টম ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। বাকি ৯৭টিও ব্যক্তিগত গাড়িতে রূপান্তরের কার্যক্রম চলছে।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ সূত্র জানায়, আগে ট্যাক্সি ক্যাব চলত ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং শহরতলি এলাকায়। নতুন গাইডলাইনের খসড়ায় এর পরিধি বাড়িয়ে খুলনা, সিলেট, বরিশালসহ বিভাগীয় শহরগুলো অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

আগের গাইডলাইনে একটি কোম্পানিকে ট্যাক্সি ক্যাব চালাতে হলে ন্যূনতম এক হাজার গাড়ি থাকার নিয়ম ছিল। নতুন গাইডলাইনের খসড়ায় এটি কমিয়ে ৫০০ করা হয়েছে। একটি কোম্পানির ঢাকা মহানগরের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ও সর্বনিম্ন ৫০০ ক্যাব থাকতে হবে। চট্টগ্রাম মহানগরের জন্য সর্বোচ্চ ১ হাজার, সর্বনিম্ন ৩০০। সিলেট, খুলনা ও বরিশালের জন্য সর্বনিম্ন ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ২০০ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

খসড়ায় ঢাকা মহানগরে সব কোম্পানি মিলে সর্বোচ্চ ২০ হাজার ট্যাক্সি ক্যাব চলাচলের অনুমতি দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ ৫ হাজার, সিলেট, খুলনা ও বরিশালে সর্বোচ্চ ১ হাজার।

খসড়ায় বলা হয়েছে, ট্যাক্সি ক্যাবের একটি নিজস্ব অ্যাপ থাকবে। সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী ট্যাক্সি ক্যাবে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করা যাবে এবং নতুন করে ইকোনমিক লাইফ নির্ধারণ করা হবে। ভাড়ার হার বাড়ানোর এবং রাত ১২টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত ১৫ শতাংশ বেশি ভাড়া নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।

ট্যাক্সি ক্যাবে সার্ভিস গাইডলাইন প্রয়োগ এবং সার্ভিসের মান উন্নয়নের জন্য পরামর্শ ও সুপারিশ দেয়ার লক্ষ্যে একটি স্থায়ী কমিটি থাকবে বলে খসড়ায় তুলে ধরা হয়েছে।

তমা কনস্ট্রাকশনের সাবেক এক কর্মকর্তা জানান, সিএনজিচালিত অটোরিকশা থ্রি-হুইলার সিন্ডিকেটের কারণে মাঠে ট্যাক্সি ক্যাব টিকতে পারেনি। সবশেষে রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের কারণে ট্যাক্সি ক্যাব সার্ভিস হারাতে বসেছে।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘পুরো বিশ্বেই ট্যাক্সি ক্যাব একটি জনপ্রিয় গণপরিবহন ব্যবস্থা। সেটা আমাদের দেশে হোঁচট খেয়েছে এবং অনেকটা জাদুঘরে চলে গেছে। এই সার্ভিসকে ব্যবসাবান্ধব, জনপ্রিয় এবং যাত্রীবান্ধব করার উদ্যোগে দুর্বলতা ছিল।’