Print Date & Time : 13 September 2025 Saturday 11:43 am

হাওরের মানুষের দুঃখ-কষ্ট কবে শেষ হবে

আশরাফুল ইসলাম: হাওর গ্রামবাংলার মানুষের কাছে এক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি। হাওর বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিস্তীর্ণ জলরাশির এক সীমাহীন প্রান্তরের ছবি। বর্ষায় পানিতে কানায় কানায় ভরে ওঠে হাওর। কান পাতলেই শোনা যায় বিশাল ঢেউয়ের গর্জন। বিশাল এ ঢেউ অনেক সময় মানুষের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। বেশিরভাগ সময় বিশাল ঢেউয়ের কবলে পড়ে মানুষের বসতভিটা ভেঙে জলে বিলীন হয়ে যায়। চারদিকে ঢেউয়ের তালে বাড়তে থাকে মানুষের হাহাকার আর তীব্র আর্তনাদ। দিন যতই যায়, হাওরের মানুষের সংকট ততই গভীর হয়।

মূলত হাওর হলো সাগরসদৃশ পানির বিস্তৃত প্রান্তর। হাওরের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো প্রতি বছরই মৌসুমি বর্ষায় হাওর প্লাবিত হয়। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পানিতে নিমজ্জিত থাকার পর বর্ষা শেষে হাওরের গভীরে পানিতে নিমজ্জিত থাকা বিল জেগে ওঠে। হাওর অনেকটা গামলা আকারের জলাভূমি। বর্ষাকালে সাগরসদৃশ হাওরগুলোর মধ্যে অবস্থিত গ্রামগুলোকে অনেকটাই দ্বীপ বলে প্রতীয়মান হয়।

বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, দেশে মোট ৪১৪টি হাওর রয়েল। অন্যদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবমতে, বাংলাদেশে হাওরের সংখ্যা ৪২৩টি। এর মধ্যে সুনামগঞ্জে ১৩৩, সিলেটে ৪৩, হবিগঞ্জে ৩৮, মৌলভীবাজারে ৪, কিশোরগঞ্জে ১২২, নেত্রকোনায় ৮০ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিনটি হাওর রয়েছে। বাংলাদেশে শনির হাওর, হাইল হাওর ও হাকালুকি হাওর বিখ্যাত হাওরগুলোর মধ্যে অন্যতম।

বছরের একটি লম্বা সময় ধরে পানিবন্দি থাকে হাওর এলাকার মানুষ। বিশাল জলরাশির ভেতরে হাওরের গ্রামগুলোকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো দেখায়। বর্ষায় সামান্য বাতাসে হাওর উত্তাল হয়ে ওঠে। বিশাল ঢেউয়ের বহর একের পর এক বসতভিটায় আছড়ে পড়ে। মূলত যে হাওর যত বেশি গভীর, সে হাওরে ঢেউ তত বেশি আছড়ে পড়ে। অনেক সময় বসতভিটার মাটিতে ঢেউ আছড়ে পড়ার কারণে ভেঙে পানির সঙ্গে চলে যায়। ফলে বসতভিটার আয়তন সংকুচিত হয়ে যায়। এটা হাওরের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। হাওরের মানুষ তাদের জীবন-জীবিকা ঢিকিয়ে রাখার জন্য প্রতিনিয়তই প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে চলেন। হাওর অঞ্চলের মানুষ মূলত এসব প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করেই বেঁচে আছেন।

হাওর অঞ্চলের মানুষের সমস্যার শেষ নেই। প্রকৃতির সঙ্গে রীতিমতো সংগ্রাম করে তাদের বেঁচে থাকতে হয়। হাওরের প্রধান সমস্যা হলো যোগাযোগ ব্যবস্থা। বর্ষার সময় নৌকা ও ট্রলার ছাড়া যোগাযোগের আর কোনো মাধ্যম থাকে না। হেমন্তে যখন পানি থাকে না, তখন পায়ে হেঁটে এক এলাকা থাকা আরেক এলাকায় যাতায়াত করতে হয়। হাওরের যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে স্থানীয় একটি সার্থক প্রবাদ আছেÑ‘বর্ষায় নাও, হেমন্তে পাও।’ হাওরবাসীর পশ্চাৎপদতার পেছনে মূলত প্রাচীন যোগাযোগ ব্যবস্থাই দায়ী।

হাওর এলাকার বেশিরভাগ মানুষই গরিব। তাদের অধিকাংশই মূলত কৃষিকাজ ও মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। তাদের আয়-রোজগার খুবই সীমিত। এই সীমিত আয় দিয়ে খুব কষ্ট করে তারা সংসার চালায়। হাওরের অর্থনীতি পুরোপুরি কৃষির ওপর নির্ভরশীল। আর এ অঞ্চলের প্রধান ফসল বোরো ধান। হাওরে কৃষকদের একটি বড় অংশই মহাজনদের কাছ থেকে সুদে ঋণ নিয়ে ফসল আবাদ করে থাকেন। হাওরাঞ্চল প্রতিবছর আগাম বন্যা ও শিলাবৃষ্টির কবলে পতিত হয়। তাছাড়া হাওরের মানুষের আরেক আতঙ্কের নাম বেড়িবাঁধ। প্রতিবছর বেড়িবাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা যেন স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। যখন কোনো প্রাকৃতির দুর্যোগে ফসল নষ্ট হয়ে যায়, তখন বাঁচার চেয়ে হতদরিদ্র কৃষকের কাছে মহাজনের ঋণের বোঝা বেশি ভারী হয়ে ওঠে।

একসময় হাওরের জমি, জল, ফসল ও মাছের মালিকানা হাওরবাসীর কাছে থাকলেও কালের পরিক্রমায় ইজারাদাররা পরে মাছের মালিকানা পেয়ে যান। কমরেড বরুণ রায়, আলফাত ও মুক্তারের নেতৃত্বে ‘জল যার জলা তার’ সেøাগান নিয়ে দীর্ঘদিন আন্দোলন করলেও হাওরের মানুষ মাছের মালিকানা আর ফিরে পায়নি। যদি জোতদারদের কাছ থেকে সাধারণ জেলেদের মাছের মালিকানা ফিরিয়ে দেয়া যেত, তাহলে হাওরের দুঃখ-কষ্ট অনেকটাই কমে আসত।

পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে হাওরগুলো এখন আর আগের অবস্থায় নেই। যেসব খাল হাওরের বিলগুলোকে নদীর সঙ্গে যুক্ত করত, বাঁধের কারণে এখন সেগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে। আবার খালের মুখে অনেক ক্ষেত্রেই সুইস গেট নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে মাছের প্রজনন ও লালনভূমিগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। নির্বিচারে মৎস্য নিধন, রাসায়নিক বর্জ্য ও বিল শুকিয়ে মাছ ধরার কারণে হাওরের পরিবেশে তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটেছে। প্রতিবছর নদী ও হাওরে প্রচুর পলি জমা হয়। নদী ও হাওরগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি ধারণ করে রাখতে পারে না। ফলে পানি উপচে মানুষের বসতভিটায় উঠে যায়। এতে হাওরবাসীর দুঃখ-কষ্ট আরও চরম আকার ধারণ করে।

শিক্ষা-দীক্ষায় হাওরাঞ্চল এখনও অনেক পিছিয়ে রয়েছে। বছরের অধিকাংশ সময় হাওরাঞ্চল পানিতে নিমজ্জিত থাকায় শিশুরা নিয়মিত স্কুলে যেতে পারে না। তাছাড়া পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত অসুবিধার কারণে হাওরাঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। অধিকাংশ এলাকাতে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ও প্রযুক্তিগত সুবিধা না থাকায় শিক্ষকরাও হাওরাঞ্চলে পড়াতে আগ্রহী হন  না, বরং তারা অনত্র বদলি হয়ে যান।

হাওরাঞ্চলে চিকিৎসা সংকট বড়ই নাজুক। উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসুবিধা থাকলেও সেখানে ভালো ডাক্তার, পর্যাপ্ত লোকবল ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। তাছাড়া প্রাচীন যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে জরুরি মুহূর্তে কোনো রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। ফলে অনেক রোগী বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। অন্যদিকে প্রসূতি মা ও শিশুর মৃত্যুর হার এখানে অন্যান্য এলাকার চেয়ে অনেকে বেশি। এছাড়া হাওরাঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবও অনেক বেশি।

হাওর এলাকার উন্নয়নের জন্য সরকার ২০০০ সালে হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড গঠন করে। কিন্তু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দের অভাবে তা এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। তবে জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে ওই প্রতিষ্ঠানটিকে সচল করে হাওর উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করা দরকার।

বাংলাদেশের হাওরের মানুষ প্রতিবছরই নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হন। ঝড়-ঝঞ্ঝা, বন্যা ও খরা যেন তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। ফলে তাদের জীবন ও জীবিকার একমাত্র অবলম্বন যে হাওর, সে হাওরই অনেক সময় তাদের দুঃখ-কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই হাওরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য সরকারের সুনজর একান্ত জরুরি।

শিক্ষার্থী, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়