Print Date & Time : 8 July 2025 Tuesday 3:35 am

হাসিনার অপরিকল্পিত উদ্যোগে বেড়েছে ঢাকার যানজট

শামীম আহমেদ: রাজধানী ঢাকার অন্যতম প্রধান সমস্যা যানজট। ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকারে অপরিকল্পিত উদ্যোগের কারণে তা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যানজটের কারণে প্রতিদিন ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যক্তিগত গাড়িনির্ভরতা ও অপর্যাপ্ত গণপরিবহনের কারণেই এ জট দিন বেড়েই চলছে। অথচ গত ১৫ বছর হাসিনার সরকারের সময় নানাভাবে গণপরিবহন ব্যবস্থার বিকাশকে অনুৎসাহিত করা হয়েছে। বরং পরিকল্পিতভাবে ব্যক্তিগত গাড়ি বাড়ানোর নানা উদ্যোগে যানজট বাড়াতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কাজ করে গেছে।

সূত্রমতে, যে কোনো আধুনিক নগরীতে মোট আয়তনের ২০ থেকে ২৫ ভাগ রাস্তা বা সড়ক থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকায় আছে মাত্র আট থেকে ৯ ভাগ। তার মানে হলো, প্রয়োজনের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ সড়ক আছে এই শহরে। ঢাকা শহরের মোট এলাকা এক হাজার ৩৫৩ বর্গকিলোমিটার আর ঢাকার বর্তমান রাস্তার আয়তন দুই হাজার ২০০ কিলোমিটার, যার মধ্যে ২১০ কিলোমিটার প্রধান সড়ক। এ সীমিত সড়কের জন্য আইন দ্বারা গণপরিবহনের সংখ্যা নির্ধারণ করে দিলেও ব্যক্তিগত পরিবহনের কোনো সংখ্যা নির্ধারণ করা নেই। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাজধানীতে বেড়েছে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যমতে, ২০১০ সাল পর্যন্ত ঢাকায় নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখ ৭৫ হাজার ৫০১টি। ২০২৪ সাল শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ লাখ ৯১ হাজার ৭৮৩। অর্থাৎ গত ১৫ বছরে ঢাকার রাস্তায় মোটরযান নেমেছে ১৬ লাখ ১৬ হাজার ২৮২টি। এ সময় সড়কে নামা মোটরযানের মধ্যে বাইকের সংখ্যা ৯ লাখ ৭৩ হাজার ১৮২টি ও প্রাইভেট কার বেড়েছে এক লাখ ৮৮ হাজার ১১২টি। অথচ গত ১৫ বছরে মাত্র ২৭ হাজার ৪৩৯টি বাস ও এক হাজার ৯৩৩টি মিনিবাস বেড়েছে। এটি হিসাবে নিলে ১৫ বছরে ঢাকায় নামা গণপরিবহনের সংখ্যা ২৯ হাজার ৭৮২টি।

এছাড়া ঢাকা শহরের যানজটের অন্যতম কারণ বাইক ও প্রাইভেট কার। এসবে সরকারের কোনো বিধিনিষেধ না থাকায় এগুলোর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে যানজট কমাতে গণপরিবন হিসেবে বাস-মিনিবাস গুরুত্বপূর্ণ হলেও এগুলো নামানোর ক্ষেত্রে রয়েছে, নানা ধরনের বিধিনিষেধ, যার কারণে ইচ্ছা হলেই যে কেউ ঢাকায় বাস-মিনিবাস নামানো যায় না। আর অটোরিকশা ও ট্যাক্সি নামানোর প্রক্রিয়া আইন করে বন্ধ রাখা হয়েছে।

যদিও সড়ক পরিবহন আইনের মাধ্যমে গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের এখতিয়ার বিআরটিএ’র। এ প্রসঙ্গে আইনে বলা হয়েছে, ‘সরকার বা সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে কর্তৃপক্ষ জনস্বার্থে সমগ্র বাংলাদেশ বা যে কোনো এলাকার জন্য যে কোনো ধরনের মোটরযানের সংখ্যা নির্ধারণ করতে পারবে। কোনো এলাকায় মোটরযানের সংখ্যা নির্ধারিত সংখ্যার বেশি হলে অতিরিক্ত মোটরযান অন্যত্র চলাচলের অনুমতি দেওয়া যাবে।’ আইনের যে কোনো ধরনের মোটরযানের সংখ্যা নির্ধারণের ক্ষমতা বিআরটিএ’কে দেয়া হলেও তারা শুধু গণপরিবহন সংখ্যা নির্ধারণ করেছে। ব্যক্তিগত গাড়ির ক্ষেত্রে তাদের কোনো বিধিনিষেধ নেই।

বিআরটিএর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঢাকার ১১০টি রুটের জন্য বাস-মিনিবাসের অনুমোদিত সীমা সাত হাজার ৪৩টি। ২০ বছরের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল অতিক্রম করে ফেলায় এক হাজার ১৫০টি বাস-মিনিবাসের রুট পারমিট এরই মধ্যে বাতিল করা হয়েছে। এসব রুটে বর্তমানে মাত্র সাড়ে চার হাজার যানবাহন চলাচল করছে, যা প্রয়োজনীয় সংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। গত পাঁচ বছরে নতুন করে কোনো রুট-পারমিট দেয়া হয়নি। এছাড়া পাঁচ হাজার সিএনজি অটোরিকশা ও তিন হাজার টেক্সিক্যাবের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। মূলত ১৫ বছরের গাড়ির আয়ুষ্কাল শেষ হলে তা এ সংখ্যার সঙ্গে সমন্বয় করা হয়।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ঢাকার সড়কের ৮৮ শতাংশ ব্যবহার করে জনসংখ্যার মাত্র চার ভাগ মানুষ। অর্থাৎ ৯৬ শতাংশ মানুষের জন্য সড়ক রয়েছে ১২ শতাংশ। ড্যাপের হিসাব বলছে, রাজধানীতে চলাচলকারী যানবাহনের মাত্র চার শতাংশ গণপরিবহন। বাকিগুলো ব্যক্তিগত। এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক শেয়ার বিজকে বলেন, ঢাকার পরিবহণ ব্যবস্থায় গোড়াতে গলদ আছে। রাস্তার তুলনায় এখানে পরিবহনের সংখ্যা বেশি। যানজট কমাতে ধারণক্ষমতার কম গাড়ি নামাতে হবে। তাহলে বিষয়টি ম্যানেজ করা যাবে, কিন্তু কর্তৃপক্ষ বেহুশ হয়ে আছে। বিআরটিএর কাছে যে-ই যাচ্ছে, তাকে রাস্তায় নামার অনুমতি দিচ্ছি। কতগুলো অপেশাদার এসব জায়গায় বসে শুধু ঢাকা কেন পুরা বাংলাদেশকে বিগত সরকারের সময় ডুবিয়েছে তারা।

এদিকে শেখ হাসিনা সরকার বিগত ১৫ বছর সাতটি ফ্লাইওভার ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করে। ব্যক্তিগত গাড়িনির্ভর এসব অবকাঠামো যানজট কমাতে কোনো ভূমিকা রাখছে না। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হলেই ঢাকার যানজট কমে যাবে। তবে তা যানজট না কমিয়ে উল্টো গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক বলেন, ঢাকা শহরের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প মূলত ঢাকাকে ডুবানোর জন্য করা হয়েছে। এসব অপরিকল্পিত প্রকল্প একটা ঠিক করতে গিয়ে আরেকটা নষ্ট করেছে। কিন্তু যারা প্রকল্প থেকে সুবিধা পাওয়ার কথা, তারা কিন্তু ঠিকই পেয়েছে। তারা বিদেশ ঘুরেছে, প্রকল্পে গাড়ি পেয়েছে। সুতরাং ঢাকা ডুবল কি ডুবল না, তা তাদের দেখার বিষয় নয়। তিনি আরও বলেন, ঢাকা কোনো দিন বসবাসের উপযুক্ত হবে না, কারণ বিগত সরকার ঢাকার অপূরণীয় ক্ষতি করে গেছে। অমিত সম্ভাবনা ছিল ঢাকার বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা নৌপথ, সড়কপথ ও রেলপথের। কিন্তু অপরিকল্পিত উন্নয়ন দিয়ে এসব প্রতিটিকে সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে।

যানজট নিরসনে করণীয় জানতে চাইলে ড. এম শামসুল হক শেয়ার বিজকে বলেন, অন্য যেকোনো দেশে এসব পদে বিশেষজ্ঞরা থাকেন, কিন্তু আমাদের এখানে আমলারা। তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। তারা আসেন, কাজ করে চলে যান। আবার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোয় যারা নীতিনির্ধারক পর্যায়ে আছেন, কেউই কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন বা আধুনিক গণপরিবহনের লোক নন। তারা সবাই আমলা, ফলে তারা সাধারণ বুদ্ধিতে বা বিভিন্ন চাপে এলোমেলো সিদ্ধান্ত নেন। পেশাদার না হওয়ায় গণপরিবহনের মূল সমস্যা না বুঝে উপসর্গ দেখে পদক্ষেপ নেন। সমাধানের জন্য বিজ্ঞান কী বলছে, সেদিকে মনোযোগ দেন না। লাফ দিয়ে চলে যান আইন প্রয়োগে। অথচ সিস্টেম ও প্ল্যান সঠিক হলেই তো হয়ে যায় অনেক কাজ। ভুল প্ল্যানে আইন প্রয়োগে টেকসই ফল আসবে না। সড়কের যতগুলো নিয়ন্ত্রক সংস্থা আছে ডিটিসিএ, বিআরটিসি সবাই অপেশাদার লোকজন চালায়। তারা শুধু সমস্যা তৈরি করতে পারে, আর কোনো কিছু হলে ঠেকা দিতে পারে।

এ পরিবহন বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, এখন আমাদের সামনে একটা সুযোগ এসেছে এসব ড্যামেজ সারিয়ে তোলার। বিশ্বের সফল দেশগুলো কীভাবে এসব করেছে তার দিকে নজর দিতে হবে। তারা যার কাজ তাকে দিয়ে করাতে হবে। আমলানির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। মন্ত্রণালয়, সচিব সবাই সহযোগিতা করার জন্য থাকবেন, কিন্তু নেতৃত্বে থাকবেন এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তারা। আমলা থাকবেন নন-টেকনিকাল ইস্যুগুলো সমাধান করার জন্য। এখন সুর্বণ সুযোগ এসেছে সংস্কার করার জন্য, আমলাতত্ত্ব নির্ভরতা কমাতে হবে। সকল মন্ত্রণালয় চালাতে হবে, এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ যারা আছেন তাদের দিয়ে তাহলে ঢাকাকে বসবাস উপযুক্ত করা যাবে।