Print Date & Time : 28 July 2025 Monday 3:53 am

হাসিনার উত্থান ও মেগাপ্রকল্পের ব্যয়ে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ !

বিশেষ প্রতিনিধি: ৯ম জাতীয় সংসদের মন্ত্রিসভায় সদস্যরা শপথ নিয়েছিলেন ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। পরের তিনটি জাতীয় নির্বাচনে কারচুপি ও অপকৌশলে সরকার বহাল রাখে আওয়ামী লীগ; যার পতন হয় গত বছর ৫ আগস্ট। স্বৈরাচারী এ শাসনামলের প্রথম দুই মেয়াদে একের পর এক মেগাপ্রকল্প গ্রহণ করে শেখ হাসিনার সরকার।

যদিও প্রতিটি মেগাপ্রকল্পের ব্যয় নিয়েই নানা সময় প্রশ্ন ওঠে। নির্মাণকাজে দুর্নীতির অভিযোগও ওঠে। তবে সেসব অভিযোগ আমলে না নিয়ে উল্টো দফায় দফায় বাড়ানো হয় বিভিন্ন মেগাপ্রকল্পের নির্মাণব্যয়। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি মেগাপ্রকল্পের নির্মাণব্যয় বিশ্বে সর্বোচ্চ। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের তথ্য উঠেছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রণীত শ্বেতপত্রে। তথ্যমতে, বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, যার নির্মাণব্যয় বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ। পাবনার রূপপুরে রাশিয়ার ভিভিইআর ১২০০ প্রযুক্তিতে দুই ইউনিটের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণব্যয় এশিয়া দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জাপান, ফিনল্যান্ড, সেøাভাকিয়া রিপাবলিক, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ভারত, এমনকি রাশিয়াকেও পেছনে ফেলেছে রূপপুরের নির্মাণব্যয়।

চুক্তির তথ্য অনুযায়ী, রূপপুরের মূল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে এখন পর্যন্ত ব্যয় দেখানো হয়েছে ১৩ দশমিক ২০ বিলিয়ন (এক হাজার ৩২০ কোটি) মার্কিন ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। এই কেন্দ্রের জন্য অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে খরচ হবে আরও অন্তত সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকা বা দুই বিলিয়ন ডলার। এই হিসাব রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প নির্মাণব্যয়ের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ভিভিইআর প্রযুক্তিতে বাংলাদেশের নির্মাণব্যয় বিশ্বে সর্বোচ্চ। আন্তর্জাতিকভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণব্যয় মূলত হিসাব করা হয় প্রতি ১ হাজার ওয়াট (১ কিলোওয়াট) বিদ্যুৎ উৎপাদনে কত মার্কিন ডলার ব্যয় হচ্ছে তার ভিত্তিতে। একে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে প্রতি ইউনিট কেন্দ্র নির্মাণব্যয় বা ওভারনাইট কস্টও বলে। ওয়ার্ল্ড নিউক্লিয়ার এজেন্সি ও সংশ্লিষ্ট দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ভারত, রাশিয়া, তুরস্ক, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ইউনিট নির্মাণব্যয় গড়ে ১ হাজার ৫৫৬ ডলার থেকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৮১ ডলার। কিন্তু রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ইউনিট নির্মাণব্যয় ৫ হাজার ৮৯০ ডলার। এমনকি যে রাশিয়ার প্রযুক্তিতে রূপপুর নির্মিত হচ্ছে, সেখানেও একই প্রযুক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ইউনিট নির্মাণব্যয় ৪ হাজার ৭৫ ডলার।

রূপপুরের ব্যয় কতটা বেশি তার উদাহরণ শ্বেতপত্রে তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ভারতের তামিলনাড়–র কুদামকুলামে চতুর্থ ও পঞ্চম ইউনিট (দুই হাজার মেগাওয়াট) পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ছয় দশমিক ৭০ বিলিয়ন (৬৭০ বিলিয়ন ডলার)। এ ব্যয়কে বাংলাদেশের সক্ষমতার সমান করে হলেও (দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট) ব্যয় দাঁড়াবে আট বিলিয়ন বা ৮০০ কোটি ডলার। অর্থাৎ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ৫২০ কোটি ডলার বাড়তি ব্যয় ধরা হয়েছে। এদিকে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণব্যয়ও বাংলাদেশে সর্বোচ্চ। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিদ্ধিরগঞ্জের ৩৩৫ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে বিশ্বে সবচেয়ে ব্যয়বহুল। এর নির্মাণব্যয় কিলোওয়াটপ্রতি ৯৬১ ডলার। আর যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কিলোওয়াটপ্রতি নির্মাণব্যয় ৮০০ ডলার। পাকিস্তানের সিন্ধুতে নির্মিত আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে এ ব্যয় ৮৫৪ ডলার।

এদিকে বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামো খাতের মধ্যে টাকার অঙ্কে সবচেয়ে বড় পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প। ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যত ‘নন-আরবান হেভি রেল’ প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, তার মধ্যে এ প্রকল্পের কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয় সবচেয়ে বেশি। একইভাবে প্রথম মেট্রোরেল নির্মাণে এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ঢাকার ‘এমআরটি লাইন-৬’। ঢাকার দ্বিতীয় (এমআরটি লাইন-১) ও তৃতীয় (এমআরটি লাইন-৫, নর্দান রুট) মেট্রোরেলের কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয় আরও বেশি। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয় পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ। বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের মধ্যে বাস্তবায়নাধীন বাস র?্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল।

আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে দেশে চার-ছয় লেনের মহাসড়ক, এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভার, রেলপথ, রেল সেতু, বিমানবন্দরের টার্মিনালের মতো যেসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, তার বেশিরভাগেরই নির্মাণব্যয় গোটা পৃথিবীতে সমজাতীয় প্রকল্পগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ বা অন্যতম সর্বোচ্চ। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) বিভিন্ন বৈশ্বিক সংস্থার পর্যালোচনার হিসাবেও বিষয়গুলো বারবার উঠে এসেছে। সূত্রমতে, বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যয়বহুল সেতু দেশের সবচেয়ে আলোচিত পদ্মা সেতু। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। সেতুটি নির্মাণে স্বাভাবিকের চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ বেশি অর্থ খরচ হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর এ সেতুর দুদিকে নির্মিত ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল মহাসড়ক।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণ বিশ্বে সবচেয়ে ব্যয়বহুল। এখানে প্রতি কিলোমিটার চার বা ততোধিক লেনের সড়ক নির্মাণ করতে ২৫ লাখ থেকে ১ কোটি ১৯ লাখ ডলার পর্যন্ত ব্যয় হচ্ছে। নির্মাণব্যয় বেশি হওয়ার জন্য উচ্চমাত্রায় দুর্নীতি, সময়মতো কাজ শেষ না হওয়া এবং দরপত্র প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতা না থাকাকে দায়ী করেছে বিশ্বব্যাংক। একইভাবে মেট্রোরেলের নির্মাণে অন্যান্য দেশের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। মেট্রোরেল নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের বিভিন্ন শহরে মেট্রোরেল নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয়েছে দুই দশমিক ৭৪ থেকে ছয় দশমিক ৫৩ কোটি ডলার। অথচ উত্তরা-মতিঝিল রুটে এ ব্যয় ছিল ১২ দশমিক ৮৯ কোটি ডলার। অর্থাৎ ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে মেট্রোরেল নির্মাণ দুই থেকে চারগুণ।
মেয়র হানিফ (গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী) ফ্লাইওভার নির্মাণব্যয়ও বিশ্বে সর্বোচ্চ। এটি নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। অথচ ভারতে এ ব্যয় ১০০ কোটি টাকারও কম। আর এয়ারপোর্ট-গাজীপুর বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) নির্মাণব্যয়ও বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। এছাড়া কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণব্যয়ও বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে বেশি। এভাবেই উন্নয়নের নামে বিশ্বের ব্যয়বহুল বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ফাঁকে অর্থ পাচার করেছে হাসিনা সরকার।

প্রসঙ্গত, শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন বা ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় পাচারকৃত যার পরিমাণ প্রায় ২৭ লাখ কোটি টাকা। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর দেশ থেকে গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি বছর পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, হংকং, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে এসব অর্থ পাচার হয়।