শেয়ার বিজ ডেস্ক: মূলত ছয়টি ব্যাংককে লক্ষ্য রেখে অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ করা হবে, যার মধ্যে পাঁচটি ব্যাংকের শেয়ার সিঙ্গাপুরে বসবাসকারী বাংলাদেশী ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এস আলম গ্রুপের হাতে রয়েছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ শাসনামলে ব্যাংক খাত থেকে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এর প্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলোর সম্পদ পর্যালোচনা (অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ) করতে বিখ্যাত তিনটি আর্থিক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান—ইওয়াই, ডেলয়েট এবং কেপিএমজিকে নিয়োগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সংবাদমাধ্যম ফিনানশিয়াল টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এমনটা জানিয়েছেন বাংলাদেশ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান মনসুর।
সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ব্যাংক থেকে পাচার করা অর্থ দিয়ে কেনা সম্পদ খুঁজে বের করতে এবং দায়ীদের বিচারে সহায়তা করতে ১১টি যৌথ তদন্ত দলও গঠন করেছে। তদন্তে বাংলাদেশের শীর্ষ ১০টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার আত্মীয়রা নজরদারিতে থাকবেন।
তিনি বলেন, তিনটি আন্তর্জাতিক অ্যাকাউন্টিং ফার্ম ইতিমধ্যে ‘অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ’ শুরু করেছে। ‘পর্যালোচনার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর সম্পদ মূল্যায়ন করা হবে এবং খুঁজে বের করা হবে কোন সম্পদ কার্যকর এবং কোনগুলো অকার্যকর। এছাড়া, কে এই সম্পদগুলো নিয়েছে এবং কীভাবে সেগুলো ব্যবহৃত হয়েছে তা বের করতে একটি ফরেনসিক অডিটও করব,’ বলেন তিনি।
আন্তর্জাতিক অডিট ও পরামর্শ সেবা প্রদানকারী সংস্থা কেপিএমজি জানিয়েছে, তারা তাদের শ্রীলঙ্কার কার্যালয়ের মাধ্যমে এই পর্যালোচনায় সহায়তা করবে। তবে অন্য দুটি অডিট সংস্থা ইওয়াই এবং ডেলয়েট এখনও মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
সাবেক আইএমএফ কর্মকর্তা মনসুর জানান, তার কাজ হলো বাংলাদেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা এবং পাচার হওয়া অন্তত ২ ট্রিলিয়ন টাকা উদ্ধার করা—যেগুলো তার মতে, শেখ হাসিনার শাসনামলে আত্মসাৎ করা হয়েছে।
গত বছরের অক্টোবর মাসে ফিনান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মনসুর বলেছিলেন, দেশের বেশ কিছু শীর্ষ ব্যাংক সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার (ডিজিএফআই) সহায়তায় দখল করা হয়েছিল, কিছু ক্ষেত্রে ‘অস্ত্রের মুখে’।
তিনি জানান, মূলত ছয়টি ব্যাংককে লক্ষ্য রেখে অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ করা হবে, যার মধ্যে পাঁচটি ব্যাংকের শেয়ার সিঙ্গাপুরে বসবাসকারী বাংলাদেশী ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এস আলম গ্রুপের হাতে রয়েছে।
এই তদন্তের অংশ হিসেবে, এসব ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের ছুটি নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে যাতে সম্পদের মান যাচাইয়ে কোন প্রকার বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়, বলেন মনসুর।
এছাড়া, বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এই মাসে এস আলমের দুই পুত্রসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নিয়ে ১১ দশমিক ৩ বিলিয়ন টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা দায়ের করেছে। মামলা সংশ্লিষ্ট একাধিক সম্পত্তি জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকার আদালত।
এস আলমের আইনজীবী কুইন এম্যানুয়েল উরকহার্ট অ্যান্ড সুলিভান ফিনান্সিয়াল টাইমসকে জানিয়েছেন, তিনি এবং তার ব্যবসায়ীরা ‘কোনো ধরনের অন্যায় কাজ করেননি এবং যদি প্রয়োজন হয়, তারা বাংলাদেশের মধ্যে তাদের বিনিয়োগ রক্ষা করার জন্য আইনি পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত’।
কুইন ইম্যানুয়েল আরও জানান, এস আলম এবং তার গ্রুপের বিনিয়োগকারীরা ‘স্বচ্ছতা এবং আন্তর্জাতিক মানের তদন্তকে স্বাগত জানায়, তবে তারা মনে করে ব্যাংকিং খাত সংস্কারে ইউনূস সরকারের টাস্কফোর্সের প্রধান হিসেবে কাজ করার কারণে মনসুরের ভূমিকা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে।
এস আলমের আইনজীবীরা, গত মাসে ইউনূসকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে তারা ঢাকার সাথে তাদের বিরোধ নিষ্পত্তি করতে না পারলে আন্তর্জাতিক সালিশ শুরু করতে প্রস্তুত রয়েছেন। এস আলম ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার এবং অন্য কোনও অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’ বলেও উল্লেখ করেন তারা।
তবে যুক্তরাজ্যসহ দেশের বাইরে পাচার হওয়া অর্থ খুঁজে বের করতে এবং পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক সহায়তা নিচ্ছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার, যার মধ্যে রয়েছে- যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সমন্বয় কেন্দ্র এবং যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ।
ট্রেজারি বিভাগ ইউনুসের উপদেষ্টাদের কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে, কারণ বাংলাদেশ অন্য দেশ থেকে আইনি সহায়তা চাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে আর্থিক সম্পৃক্ততার অভিযোগের ঘটনায় শেখ হাসিনার ভাগনি ও লেবার পার্টির মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক পদত্যাগ করেছেন। তার এ পদত্যাগকে স্বাগত জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তাদের ধারণা, টিউলিপের পদত্যাগ হারানো অর্থ পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আরও মনোযোগ আকর্ষণ করবে।
সিদ্দিকের মুখপাত্র অবশ্য জানিয়েছেন, টিউলিপের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের কোনো প্রমাণ নেই এবং তিনি এই অভিযোগগুলো সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেছেন।
মনসুর বলেছেন, জনগণের চাপের কারণে টিউলিপ সিদ্দিক পদত্যাগ করেছেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া দেখে উৎসাহিত। রাজনীতিবিদরা এনিয়ে সচেতন আছেন এবং আশা করি তারাও তাদের দেশের ভেতরে জনগণের চাপের কাছে নত হবে এবং অর্থ পুনরুদ্ধারের এই প্রচেষ্টাকে সমর্থন করবে।’