মাইফুল জামান ঝুমু : ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের কথা, ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের উদুপির গভর্নমেন্ট গার্লস পিইউ কলেজে স্কার্ফ পরিহিত কয়েকজন মুসলিম নারী শিক্ষার্থীকে ক্লাস করতে বাধা দেয়া হয়। তখনই শুরু হয় কর্ণাটকের হিজাব বিতর্ক আন্দোলন। আর এই হিজাব বিতর্কের তোপে পড়েই একপর্যায়ে কয়েক দিনের জন্য রাজ্যটির সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পরে ২০২৩ সালের ২২ ডিসেম্বর কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী কর্তৃক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব পরার অনুমতি দেয়া হয়।
হিজাব পরা নিয়ে এই বিতর্ক শুধু ভারতেই হচ্ছে তা নয়, বরং বিশ্বের অনেক দেশেই মুসলিম নারীরা এই হিজাববৈষম্যের শিকার হচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বের ছোঁয়ায় বর্তমানে বাংলাদেশের মতো সংখ্যাগুরু মুসলিম দেশেও দেখা যাচ্ছে হিজাব নিয়ে বৈষম্য। গত ২৮ এপ্রিল বান্দরবান পিটিআইতে অনুষ্ঠিত বিটিপিটির (বেসিক ট্রেনিং ফর প্রাইমারি টিচার্স) চূড়ান্ত মৌখিক পরীক্ষায় পর্দানশিন শিক্ষিকা মাশরুফা সাঈদার সঙ্গে হিজাব নিয়ে অশোভন আচরণের খবর দেশবাসীর কাছে উঠে আসে। এ ঘটনায় তার সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, এতে শুধু কোনো নারীর প্রতি অবমাননাই করা হয়নি, বরং সংবিধান, ধর্মীয় স্বাধীনতা, এমনকি নারীর গোপনীয়তার অধিকারের চরম লঙ্ঘন ঘটেছে। সংবিধানের ২৭নং ধারায় আইনের চোখে সব নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। ২৮নং ধারায় নারীর প্রতি বৈষম্য করতে নিষেধ করা হয়েছে। আবার সংবিধানের ৪১নং ধারায় সব নাগরিকের যার যার ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী জীবনযাপনের অধিকারের কথা স্পষ্ট উল্লেখ আছে। অথচ রাষ্ট্রকাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ অংশ ভাইবা বোর্ডেই হচ্ছে সংবিধান পালনে অবমাননা। রাষ্ট্রের নিজস্ব প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এরকম অবমাননা করাটা কি কাম্য? যখন একটি রাষ্ট্রের নিজস্ব প্রতিনিধিরা বারবার নারীর স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করে, তখন মনে প্রশ্ন জাগেÑআদৌ এদেশে নারী স্বাধীনতা আছে কি না?
শুধু চাকরিক্ষেত্রেই নয়, আজকাল বাংলাদেশের অনেক স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে অধিকার সচেতন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও হিজাব নিয়ে একপ্রকার বৈষম্য করা হচ্ছে। হিজাব দেখলেই একশ্রেণির লোকের ফোবিয়া সৃষ্টি হয়। হিজাবের কারণে ক্লাসে শিক্ষার্থীদের বুলিং, পরীক্ষায় অংশগ্রহণে বাধা প্রদান, শিবির কিংবা জঙ্গি ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া প্রভৃতি এখন সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকাল এক মুসলিম আরেক মুসলিমের হিজাবের ওপর হস্তক্ষেপ করছে। এক সংখ্যাগুরু আরেক সংখ্যাগুরুর দ্বারা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আবার আমাদের সমাজের কিছু মুসলিম জনগোষ্ঠীও মনে করেন, ‘হিজাব-নিকাব পরা নারীদের মাধ্যমেই অনেক অপরাধমূলক কাজ, যেমন চুরি, ছিনতাই, শিশু অপহরণ প্রভৃতি বেশি সংঘটিত হয়ে থাকে।’ আর এ অন্ধ ধারণার ফলে হিজাব-নিকাব পরিহিত সাধারণ মুসলিম নারীরা দিনের পর দিন অপমানিত, লাঞ্ছিত আর নিগৃহীত হচ্ছে।
২০২২ সালে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমরা তাদের হিজাব অধিকার নিয়ে প্রতিবাদ করলেও বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মুসলিমরা আজও এ সমস্যার তেমন কোনো সমাধান আনতে পারেনি। ফলে ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন দেশেও মুসলিম নারী হিজাবোফোবিয়ায় আক্রান্ত মানবদের পদতলে পিষ্ট। মোটাদাগে বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাবোফোবিয়াদের ছোবল বেশি সংক্রমিত হচ্ছে। হিজাব নিয়ে বিতর্কের বিষয়টি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, এ ব্যাপারটি বুঝতে তারা নারাজ। পোশাক আমাদের মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশ যেহেতু একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র এবং সংবিধান অনুযায়ী সব নাগরিকের ইচ্ছাধীন পোশাক পরিধানের স্বাধীনতা যেহেতু রয়েছে, সেহেতু কারও পোশাকের ওপর হস্তক্ষেপ করা ফৌজদারি অপরাধের শামিল। আমাদের দেশে নাগরিকের হিজাব ছাড়া চলার অধিকার যেমন রয়েছে, তেমনি হিজাব পরিধান করার অধিকারও রয়েছে। কাজেই হিজাব-নিকাব নিয়ে যুক্তিতর্ক কিংবা হিজাবের ওপর নির্ভর করে কাউকে প্রশ্নবিদ্ধ করা একটি নীতিগর্হিত কাজ। আমরা যখনই হিজাব-নিকাব পরা কাউকে কোনো দুষ্কর্ম করতে দেখি, তখনই মোটাদাগে সব হিজাব পরিধেয় নারীকে অপবাদ দেয়া শুরু করি। কিন্তু হিজাব পরিধেয় ছাড়াও কিছু নারী আছে যারা বিভিন্নভাবে দুর্নীতিতে জড়িয়ে যাচ্ছে, তাদের দায়ভার কে নেবে? নির্দিষ্ট কোনো পোশাকের ভিত্তিতে কাউকে দোষারোপ করে দুর্নীতি বা অপকর্ম কমানো যায় না, বরং অপকর্ম কমাতে প্রয়োজন অবকাঠামোগত পরিবর্তন।
হাইকোর্ট কর্তৃক হিজাবকে নারীর সাংবিধানিক অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হলেও বর্তমানে আমাদের দেশের অধিকার সচেতন নাগরিকরাই হিজাব নিয়ে বেশি বৈষম্য করছে। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় হিজাব পরিহিত নারীদের এমনভাবে তিরস্কার করা হচ্ছে যে, একজন নারী মানসিকভাবে ব্যাঘাতগ্রস্ত হচ্ছে। অজস্র আত্মত্যাগের বিনিময়ে দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতার পরও যদি নারীদের হিজাব নিয়ে এরূপ প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়, তাহলে আওয়ামী সরকার আর এ সরকারের মধ্যে কোনোই পার্থক্য রইল না। কিন্তু এ হিজাবোফোবিয়ার শেষ কোথায়? এভাবে আর কত নারীকে হিজাব নিয়ে তিরস্কার শুনতে দেখলে, আর কত নারীকে হিজাবের আড়ালে চোখের অশ্রু ফেলতে দেখলে এদেশ থেকে হিজাবোফোবিয়ার উচ্ছেদ ঘটবে? ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক দিক থেকে নয়, বরং সাংবিধানিক আইনের দৃষ্টিতে এদেশে যাদের হিজাবোফোবিয়া আছে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। প্রমাণ ছাড়া শুধু পোশাকের ওপর ভিত্তি করেই কাউকে জঙ্গি, শিবির কিংবা শিশু অপহরণকারীর ট্যাগ দেয়া যাবে না। প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের ‘হিজাব নিয়ে নারীর ওপর হস্তক্ষেপ নয়’ বিষয়ক কর্মশালা আয়োজন করা প্রয়োজন। নারীর হিজাবের ওপর হস্তক্ষেপ ফৌজদারি অপরাধ। এ ব্যাপারে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সবাইকে অবগত রাখতে হবে এবং এ ধরনের অপরাধের জন্য বিচার বিভাগকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন কর্ম প্রতিষ্ঠানে নারীদের যৌন হয়রানির পাশাপাশি হিজাব হয়রানির ব্যাপারে সবাইকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মাধ্যমেই দীর্ঘদিনের জিইয়ে থাকা অন্যায়ের অবসান ঘটানো সম্ভব।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়