মো. মিজানুর রহমান: প্রতিদিনই সারা বিশ্বে কোনো না কোনো দিবস পালিত হয়। ঠিক তেমনিভাবে আজ ১০ নভেম্বর সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে বিশ্ব হিসাববিজ্ঞান দিবস। কিন্তু এই দিবসটির আদ্যোপান্ত খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে মানব সভ্যতার সেই পুরনো দিনগুলোতে, যখন মানুষ গাছের গায়ে, গুহা কিংবা পাথরে খোদাই করে হিসাব রাখত। বস্তুতপক্ষে মানব সভ্যতার ইতিহাসের মতো অ্যাকাউন্টিং বা হিসাববিজ্ঞানের ইতিহাসও বেশ পুরনো। পরে সময় এবং চাহিদার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হিসাব সংরক্ষণের পদ্ধতিরও পরিবর্তন হয় এবং তারই ফলে একটা সময় হিসারেব বইতে অঙ্কের মাধ্যমে লেখা শুরু হয়। ইতালিয়ান গণিতবিদ ও দার্শনিক লুকা প্যাসিওলিকে হিসাববিজ্ঞানের জনক বলা হয়। কারণ তিনিই ‘সুম্মা ডি এরিথমেটিকা জিওমেট্রিকা প্রপোরশনিয়েট প্রপোরশনালিটা’ গ্রন্থে হিসাবরক্ষণের ধারণাটি সর্বপ্রথম তুলে ধরেন। ওই বইয়ের ‘পারটিকুলারিজ ডি কমপিউটিজ এট স্ক্রিপটুরিজ’ শীর্ষক অধ্যায়ে হিসাবরক্ষণের প্রধান মূল নীতি দুতরফা দাখিলা পদ্ধতির ব্যাখ্যা করেছিলেন। ওই মূলনীতি থেকেই পরে জাবেদা, খতিয়ান, লাভ-ক্ষতি হিসাব, সম্পদ ও দায়ের হিসাবরক্ষণ ও উদ্বৃত্তপত্র তৈরির ধারণা পাওয়া যায়। ১৪৯৪ সালের ১০ নভেম্বর এই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল বলে ১০ নভেম্বর সারা বিশ্বের সব হিসাব পেশাজীবীদের কাছে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন।
যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র সর্বপ্রথম হিসাব বিজ্ঞানকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দান করে। এরই ফলে ১৮৫৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘দি এডিনবার্গ সোসাইটি অব অ্যাকাউন্টেন্টস অ্যান্ড গ্লাসগো ইনস্টিটিউট অব অ্যাকাউন্টেন্টস অ্যান্ড অ্যাকচুয়ারিজ’ নামে অভিন্ন দুটি হিসাব পেশাজীবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরে অন্যান্য দেশেও অনানুষ্ঠানিকভাবে আরও কিছু হিসাব পেশাজীবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। বিশ্বজুড়ে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হিসাব পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে একত্রিত করে ১৮৮০ সালে ‘দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস অব ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েল্স’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ক্রমেই বিস্তার লাভ করে হিসাববিজ্ঞান পেশা। ১৮৮৭ সালে যাত্রা শুরু করে ‘দি আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব সার্টিফাইড পাবলিক অ্যাকাউন্ট্যান্টস’। ১৯২৯ সালের শেয়ার বাজার ধসের পর হিসাব বিজ্ঞান পেশার জন্য ‘জেনারেলি অ্যাকসেপটেড অ্যাকাউন্টিং প্রিন্সিপাল’ গৃহীত হয়। ১৯৭২ সালে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড বোর্ড এবং গভর্নমেন্ট অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড বোর্ডে এর কার্যক্রমকে মনিটরিং করার জন্য একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টিং ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইতিহাসের পাতা খুঁজলে দেখা যায়, হিসাবরক্ষকেরা প্রথম দিকে প্রাচীন মেসোপটমিয়ার বিভিন্ন মন্দিরে খাজনা আদায়ের কাজ করত। পরে তারা বিভিন্ন রাজ প্রাসাদে প্রজাদের খাজনা নির্ধারণ, সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের কাজ করত। এরই ধারাবাহিকতায় হিসাব বিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি ক্রমেই বৃৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে হিসাবরক্ষকেরা শুধু কর বা খাজনা আদায়ের কাজই করে না, বরং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারকের ভূমিকা পালন করছে। একটি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় ফান্ড সংগ্রহ এবং তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার মতো গুরুদায়িত্ব হিসাব পেশাজীবীদেরই পালন করতে হয়। তারা একটি প্রতিষ্ঠানে জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা তথা সুশাসন নিশ্চিত করে থাকে। আর তাই প্রতিষ্ঠানের অন্য যেকোনো পদের চেয়ে হিসাবরক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদা অনেক বেশি।
প্রথম দিকে হিসাববিজ্ঞান বা অ্যাকাউন্টিং বলতে ফাইনান্সিয়াল অ্যাকাউন্টিংকেই বোঝানো হতো। কিন্তু পরে এর শাখা-প্রশাখা ক্রমেই বিস্তার লাভ করে এবং গভর্নমেন্ট অ্যাকাউন্টিং, পাবলিক অ্যাকাউন্টিং, কস্ট অ্যাকাউন্টিং, ইনফ্লেশনারি অ্যাকাউন্টিং, ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিং, এনভায়রনমেন্টাল অ্যাকাউন্টিং, ট্যাক্সেশন ও অডিটিংয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে।
হিসাববিজ্ঞান পেশাকে একটি গতিশীল পেশা বলা হয়। কারণ অন্যান্য পেশার সঙ্গে হিসাব পেশাজীবীদের মূল পার্থক্য হচ্ছে অন্য পেশাজীবীদের তাদের নিজ নিজ পেশার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে হয়। কিন্তু হিসাব পেশাজীবীদের হিসাববিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে গণিত, তথ্য ও প্রযুক্তি, ব্যবস্থাপনা, যোগাযোগ, বাজারজাতকরণ, আইন, নীতি-নৈতিকতা ইত্যাদি বিষয়েও প্রয়োজনীয় জ্ঞান রাখতে হয়। ফলে হিসাববিদরা প্রতিষ্ঠানের যেকোনো পলিসি নির্ধারণী বিষয়ে পরামর্শ দিতে পারে। তাছাড়া দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক অ্যাকাউন্টিং বডিগুলো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্ট্যান্ডার্ড ও পলিসি তৈরি করে যা হিসাব পেশাজীবীদের আপ-টু-ডেট রাখতে সহায়তা করে। তাছাড়া হিসাববিদেরা যেহেতু প্রতিষ্ঠানের অর্থের মূল রক্ষক হিসেবে কাজ করে, ফলে তাদের তাদের নিজ নিজ দায়িত্বে যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হয়। হিসাববিদদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো কোনো অবস্থাতেই তারা তাদের নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয় না।
তবে অন্যান্য পেশার চেয়ে এই পেশার কর্মীদের মানসিক চাপ অনেক বেশি। একদিকে যেমন প্রতিষ্ঠানের অর্থের মূল রক্ষক এবং অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে থাকে, পাশাপাশি বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারদের রিয়েল টাইম সার্ভিসও দিতে হয়। তবে সামনের দিনগুলোতে এই পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত জনবলকে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব দরজায় কড়া নাড়ছে। ফলে হিসাব পেশাজীবীদের সামনে আরও বেশি ডাইনামিক হতে হবে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক স্ক্যান্ডাল এবং তৎসংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলোর কেইস স্টাডি করে প্রাপ্ত ফাইন্ডিংসগুলো যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার মাধ্যমে স্টেক হোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষায় আরও বেশি জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে।
হিসাববিজ্ঞান পেশা যে শুধু এই পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত জনবলের তা কোনোভাবেই বলা যাবে না। কারণ অর্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রত্যেকটি মানুষই হিসাববিজ্ঞানের সঙ্গে জড়িত। যেখানেই অর্থ এবং অর্থের ব্যবহার রয়েছে, সেখানেই হিসাববিজ্ঞান রয়েছে। একটি বিষয় খুব গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে ব্যাক্তি জীবন খেকে শুরু করে ব্যবসায়িক কিংবা রাষ্ট্রীয় এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে হিসাববিজ্ঞানের মূলনীতির ব্যবহার হয় না। হিসাববিজ্ঞান প্রতিটি মানুষকে ব্যালেন্স করে চলার শিক্ষা দেয়। একটি হিসাবের দুটি দিক সমান না হলে যেমন হিসাব মিলবে না, ঠিক তেমনি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যালেন্স থাকা দরকার। হিসাববিজ্ঞানের জনক লুকা প্যাসিওলি সেজন্যই বলেছিলেন, ‘একজন মানুষের রাতে ঘুমাতে যাওয়া উচিত নয়, যতক্ষন না পর্যন্ত তার নিজের ডেবিট এবং ক্রেডিট সমান না হয়’।
হিসাববিজ্ঞান পেশা এবং এই পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত জনবলের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রতি বছর ১০ নভেম্বর ‘বিশ্ব হিসাববিজ্ঞান বা হিসাব পেশাজীবী’ দিবস হিসেবে পালিত হয়। ধারণা করা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সার্টিফাইড পাবলিক অ্যাকাউন্টেন্টদের সংগঠন ‘সান ডিয়েগো চাপ্টার অব দি ক্যালিফোর্নিয়া সোসাইটি’ নামক একটি সংগঠন সর্বপ্রথম হিসাববিজ্ঞান দিবস পালন শুরু করে। এরপর থেকে প্রতি বছরই বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবে এই দিনটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। মূলত হিসাববিজ্ঞান পেশাকে আরও বেশি পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য এই দিনটি পালন করা হয়। দিনটি হিসাব পেশাজীবী, শিক্ষার্থী এবং যারা ভবিষ্যতে এই পেশায় আসতে চায় তাদের সবার কাছেই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। তবে বিশ্বব্যাপী হিসাববিজ্ঞান বা হিসাব পেশাজীবী দিবস পালন করা হলেও বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে দিনটি পালনের সংস্কৃতি এখনও শুরু হয়নি। বাংলাদেশে মূলত দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশ, দি ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশ, দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ, দি ইনস্টিটিউট অব সার্টিফাইড জেনারেল অ্যাকাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশ, সার্টিফাইড পাবলিক অ্যাকাউন্টেন্টস, সার্টিফাইড ফাইনান্সিয়াল এনালিস্ট, বাংলাদেশ অ্যাকাউন্টিং অ্যাসোসিয়েশন, এসিসিএ বাংলাদেশ এবং বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে পড়–য়া শিক্ষার্থীরা মূলত দিনটি জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালন করে থাকে।
পরিশেষে বলতে হয়, হিসাব পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত জনবল যেমন নিজেরা স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহিতা শক্তভাবে মেনে চলে, ঠিক তেমনিভাবে সমাজের সর্বক্ষেত্র জবাবদিহিতার সংস্কৃতি চালুর মাধ্যমে স্বচ্ছ সমাজ বিনির্মাণে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। ব্যক্তিগত, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা রাষ্ট্রীয় জীবনে হিসাববিদদের মহান অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রতি বছর বিশ্ব হিসাববিজ্ঞান বা হিসাব পেশাজীবী দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথ মর্যাদায় পালন করা উচিত।
সহযোগী সদস্য, দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি)