মোহাম্মদ আবু নোমান: কথায় আছে, ‘ইটটা মারলে পাটকেলটি খেতে হয়।’ ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট কোনো রকম বাছবিচার না করে অনেক আগে থেকেই ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে। যে তেল বেচার টাকায় অস্ত্র কিনে ইয়েমেনের স্কুল, হাসপাতাল, বিয়েবাড়ি এমনকি জানাজার শবযাত্রায়ও সৌদি আরব হামলা চালিয়েছে, সেই তেল ধ্বংসের টার্গেট হুতিদের থাকবেই। এতটুকু হামলায় যাদের তেলের উৎপাদন অর্ধেকে নেমে যায়, তারা কীভাবে তেলক্ষেত্র অরক্ষিত রেখে নাকে তেল দিয়ে ঘুমান? ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের কাছে তাদের নিরপরাধ মানুষের রক্তের চেয়ে তেলের মূল্য বেশি হতে পারে কি? হুতিরা দুর্বল হলেও তারাও যে কিছু ফাইট-ব্যাক করবে না, এমন নিশ্চয়তা বিন সালমানকে কে দিয়েছে? যুক্তরাষ্ট্রকে বন্ধু বানিয়ে অন্য একটি মুসলিম দেশে সৌদি আরব নির্বিচারে হামলা চালিয়ে সভ্য পৃথিবীর করুণা মাগতে পারে কি?
সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি সৌদি আরামকোর দুটি প্লান্টে গত ১৪ সেপ্টেম্বর হামলা করে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা। ১৯৯০-৯১ সালে উপসাগরীয় সংকটে কুয়েতের তেল কুপগুলো জ্বালিয়ে দেওয়ার পর ওই অঞ্চলের তেল স্থাপনায় চালানো সবচেয়ে বড় হামলা এটি। এই ঘটনার জেরে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে আরও সেনা মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা এ হামলার দায় স্বীকার করেছে। কিন্তু মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও হামলার জন্য ইরানকে দোষারোপ করেছেন। যথারীতি পম্পেওর এ অভিযোগ ইরান অস্বীকার করেছে। ট্রাম্প প্রশাসন বিভিন্ন বিষয়ে লাগাতার মিথ্যাচার করায় পম্পেওর অভিযোগ সবার কাছে সহজে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারছে না।
সৌদি আরব তাদের তেল স্থাপনাগুলো সুরক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় শত শত কোটি ডলার খরচ করেও কমদামি ড্রোন ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে পারেনি। তাহলে কোথায় সেই সৌদির বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। হুতিরা যদি এত নিখুঁতভাবে তাদের গুরুত্বপূর্ণ বিশাল তেলশিল্পে আঘাত করতে পারে, তাহলে সৌদির আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ অন্যান্য লক্ষ্যেও আঘাত হানতে পারবে। এটি ঠিক, সৌদি জোটের আগ্রাসনে বিপর্যস্ত হুতিরা প্রতিশোধ নিতে সৌদিতে হামলা চালাতে মরিয়া হয়ে আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এককভাবে এমন নিখুঁত হামলা চালানোর সামর্থ্য ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা কোনোটিই হুতিদের আছে কি? তেহরানের সরাসরি মদত ছাড়া তাদের পক্ষে এ ধরনের সুনিপুণ সার্জিক্যাল স্ট্রাইক পরিচালনা করা সম্ভব? সত্যিই যদি ইরান এতে জড়িত থেকে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে আসল যুদ্ধটা এখনও শুরুই হয়নি। এতদিন বিশ্ববাসী বসনিয়া, হার্জেগোভিনা, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, ইরাক, লিবিয়া, মিসর ও সিরিয়ায় যে যুদ্ধ দেখেছে, তা কেবল যুদ্ধের মহড়া মাত্র!
ইয়েমেন, সৌদি আরব, ইরান যারা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার দামামা বাজাচ্ছে, তারা আরেকটু ভেবেশুনে ঢোলে বাড়ি দিক। তেলের দাম আকাশে উঠবে, তার প্রভাব মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সব ক্ষেত্রে পড়বে। ইউরোপ শরণার্থীদের জন্য যথারীতি টাইমবোম হয়ে বসে আছে। সৌদি আর ইরানকেন্দ্রিক মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ শুরু হলে পুরো ইউরোপ আগুনের গোলায় পরিণত হবে। মাঝখান থেকে বগল বাজাবেন ট্রাম্প, পুতিন আর ইসরাইলের যুদ্ধবাজ নেতারা।
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল ও সৌদি আরবকে দিয়ে একচ্ছত্র খবরদারি করানোর যে নীতি ট্রাম্প নিয়েছেন, তালে স্পষ্টতই দেখা যায়, বিস্ফোরণোম্মুখ বারুদের বক্সে দাঁড়িয়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্য। যুক্তরাষ্ট্রের এ যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে ইসরাইলের বিপক্ষ শক্তিকে দুর্বল ও নিশ্চিহ্ন করে ফেলা। তাই সৌদিতে হামলার পর ইসরাইল ইরানে হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে উসকে দিচ্ছে। এখন আরব বিশ্বকে বুঝতে হবে নিজেদের মধ্যকার এই দূরত্বে তারা যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ঠিক ততটাই পশ্চিমা দেশগুলো ও ইসরাইল লাভবান হবে। এর জন্য নতুন একটি যুদ্ধক্ষেত্র ইসরাইল ও তার মিত্ররা তৈরি করতে চাইছে। সৌদি আরবের তেলক্ষেত্রে হামলার মাধ্যমে সেই যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে ইরানকে নির্ধারণ করে ফেলেছে ইসরাইল ও তার মিত্ররা। অভিযোগের তির ইরানের দিকেই তাক করেছে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি ও ইসরাইল। ইরানও স্বাভাবিকভাবেই অস্বীকার করেছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র যে চাল চেলেছে, তাতে সফল হবে কি? বর্তমানে ইরানকে সহজে হারানোর ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নেই বলেই মনে হয়।
মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হামলাটি ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে চালানো হয়েছে। হামলায় ড্রোনের পাশাপাশি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে বলে তিন মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন। যদিও এ অভিযোগগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে তেহরান। তারা বলেছে, ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন বাহিনীর বিরোধীরাই হামলাটি চালিয়েছে। প্রাথমিক তদন্তের ফলাফলে হামলায় ব্যবহার করা অস্ত্রগুলো ইরানি বলে ইঙ্গিত পাওয়ার কথা জানিয়েছে রিয়াদ। কিন্তু হামলাটি ঠিক কোন স্থান থেকে চালানো হয়েছে, তা নিশ্চিত হতে পারেনি। ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ড্রোনের অবস্থান ছিল পারস্য উপসাগরের উত্তর প্রান্তে (দক্ষিণ ইরানে)। বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইয়েমেনের আক্রমণ প্রতিহত করতে সৌদি আরবের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা রয়েছে দক্ষিণমুখী অবস্থানে। কিন্তু হামলা এর উল্টো দিকে হওয়ায় আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব হয়নি সৌদি আরবের। হুতি বিদ্রোহীরা এর আগেও সৌদি আরবে হামলা চালিয়েছে। তবে মার্কিন কর্মকর্তারা বলেন, এবার ড্রোন ও মিসাইলগুলো দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়নি। বরং তাদের বিশ্বাস, উত্তর বা উত্তর-পশ্চিমের ইরান অঞ্চল থেকে এ হামলা চালানো হয়েছে।
যদি ড্রোনের ঝাঁকের হামলা ইরাক বা ইরান থেকেই হয়ে থাকে, তাহলে এতসব সুদক্ষ মার্কিন প্রযুক্তি এর খবর রাখতে ব্যর্থ হলো কেন? মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের আওতাধীন নৌবাহিনীর সদর দফতর বাহরাইনের লোকজন কি অন্ধ, অদক্ষ, অলস, নির্বোধ! কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা ছবি ও গোয়েন্দা তথ্যের বরাত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে, ইরানই ওই হামলার জন্য দায়ী। তারা কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে ছবি তুলতে পেরেছে, রয়েছে গোয়েন্দা তথ্যও, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ প্রতিরোধ করেনি কেন। তাহলে কি দেশটি একান্তভাবে চেয়েছে সৌদি তেলক্ষেত্র ধ্বংস হোক? যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব বলে আসছে ইরানঘনিষ্ঠ ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা সৌদিতে বারবার আক্রমণ করছে। অথচ সে ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল অরক্ষিত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র? হাস্যকার সৌদি কর্মকর্তাদের বিবৃতি।
মোদ্দাকথা, হামলায় ইরানের হাত থাকতে পারে, আবার নাও থাকতে পারে। ইরান জড়িত থাকুক আর না থাকুক, এখানে ইরানকে কেন্দ্র করেই নতুন এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি সচেষ্ট। যেমনটা ইরাকের বিরুদ্ধে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র মজুতের অভিযোগ করা হয়েছিল। এরপর গোটা ইরাককে কারবালায় পরিণত করা হয়েছিল। নিজেদের মধ্যে যত বিভেদ থাকুক, মূলত আরবদের ঐক্য ধরে রাখা এবং ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরোধিতা করা ও নিজেদের মধ্যে হানাহানি রোধ করার লক্ষ্য নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল আরব লিগ ও উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ (জিসিসি)। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে পশ্চিমারা বরাবরই বিভিন্ন ইস্যুতে উসকে দিয়ে আরব দেশগুলোর মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়। আর এ কারণেই সমবেতভাবে ইসরাইলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে ওঠে।
২০১৫ সালে ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদিকে উচ্ছেদ করে রাজধানী সানা দখলে নেয় ইরান-সমর্থিত শিয়াপন্থি হুথি বিদ্রোহীরা। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে পালিয়ে যান হাদি। ২০১৫ সালের মার্চে হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে মিত্রদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ‘অপারেশন ডিসাইসিভ স্টর্ম’ নামে সামরিক অভিযান শুরু করে সৌদি আরব। সৌদি জোটের অভিযান শুরুর পর এ পর্যন্ত নারী-শিশুসহ ১০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে কোটি কোটি মানুষ। হিজবুল্লাহ মহাসচিব বলেন, দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত ইয়েমেনের যেসব নারী ও শিশু সৌদি আগ্রাসনে নিহত হয়েছে, আমরা তাদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করছি। তিনি বলেন, যারা আজ সৌদি তেল স্থাপনায় হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে, তারা ইয়েমেনের নারী ও শিশু হত্যার সময় কেন নীরব থাকে, তা বিশ্ববাসী জানতে চায়।
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) নিজের বৃদ্ধ বাবা বাদশাহ সালমানের বিকল্প নেতা হিসেবে নিজেকে দাঁড় করাতে ট্রাম্পকে সর্বোচ্চ মাত্রার তোয়াজ করছেন। সালমান ‘অসীম কর্তৃত্ব’ ব্যবহার করে সৌদির কৃষ্টি-কালচারের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ও অবিবেচনাপ্রসূত বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করে যাচ্ছেন। এদিকে মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রতিটি পদক্ষেপের প্রতি ট্রাম্প অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে আসছেন। প্রত্যেক জাতি বা দেশের একটা আলাদা জাতীয় পোশাক ও সংস্কৃতি থাকে। স্বাধীনতার নাম করে মুসলিম কালচার বা আরব কালচার ছেড়ে পশ্চিমা কালচার ধরতে হবে কি? পশ্চিমা মিডিয়া বরাবরই মুসলমান নারীদের খোলামেলা দেখতে চায়! প্রত্যেকের যার যার কালচার ও ধর্ম পালন করারও একটা স্বাধীনতা থাকা দরকার। শুধু পশ্চিমা কালচার বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার নাম স্বাধীনতা নয়। নিজের সংস্কৃতি বিকিয়ে অন্যের ধার করা সংস্কৃতি নিয়ে নাচানাচি কোনো দেশের জন্য ভালো ফল বয়ে আনে না।
সৌদি আরবকেও বুঝতে হবে, ইরান ঠাণ্ডা মাথার খেলোয়াড়। ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক যুদ্ধের বড় হোতা সৌদি। তাই ইরানের পক্ষ থেকে সৌদির অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডে আঘাত আসতেই পারে। এ কথাও ঠিক যে, ইরানের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার কারণেই ইসরাইল এখন ফিলিস্তিন ও লেবাননের ওপর হামলা করতে ভয় পায়। শক্তিশালী ইরান না থাকলে এত দিনে ইসরাইলের আয়তন বেড়ে ১০ গুণ হওয়া ছাড়াও লাখো মুসলমানের জীবন দিতে হতো।
ফ্রিল্যান্স লেখক