হুমকিতে টাঙ্গাইল শহররক্ষা বাঁধ

শাহরিয়ার সিফাত, টাঙ্গাইল: টাঙ্গাইলের পৌলী নদীতে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে নদীর বাঁ তীরে ৬০০ মিটার ও ডান তীরে ৮০০ মিটার এলাকা এবং আট-দশটি বাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। ডান তীরের ভাঙন টাঙ্গাইল শহর রক্ষা বাঁধ ছুঁই-ছুঁই করছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিষয়টি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে অবহিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।
২০০০ সালে ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৭ কিলোমিটার দীর্ঘ টাঙ্গাইল শহর রক্ষা বাঁধটি তৈরি করা হয়, যা ছিলিমপুর-করটিয়া বাঁধ নামে পরিচিত। দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় ভাঙনের মুখে রয়েছে টাঙ্গাইল শহর রক্ষার এই বাঁধ। বিশেষ করে বাঁধের পূর্বাংশ পংলি সেতু থেকে মহেলা, আগবেথর পাছবেথর, শালিনা, বার্থা হয়ে করটিয়া পর্যন্ত বাঁধের বিভিন্ন অংশ ভেঙে গেছে। বাঁধের পুরো অংশটি ভেঙে গেলে টাঙ্গাইল শহর, গালা, ঘারিন্দা, করটিয়া ইউনিয়নসহ বাসাইল উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকার বাড়িঘর, ফসলি জমি, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মসজিদ-মাদ্রাসা বিলীন হয়ে যাবে।
এছাড়া ঢালান শিবপুর ঘাট থেকে যুগনি পর্যন্ত প্রধান সøুইসগেট এলাকাসহ শিবপুর ও শ্যামার ঘাট এলাকায় বাঁধের বিভিন্ন অংশে ভাঙন দেখা দিয়েছে। একইভাবে শহর রক্ষা বাঁধের বিভিন্ন অংশ প্রতিনিয়ত যানবাহন চলাচলের কারণে দেবে গেছে। গত বছর বন্যায় রামদেবপুরের বাসিন্দারা নিজ উদ্যোগে মাটি ফেলে কোনো রকমে বাঁধের রামদেবপুর অংশটিকে রক্ষা করেছিলেন।
জেলা প্রশাসক খান মো. নুরুল আমিন পৌলী নদীর ভাঙন প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে গত ২০ জুন চিঠি দেন।
স্থানীয়রা জানান, বেশ কিছুদিন ধরে পৌলী নদীতে বর্ষার পানি এসেছে। কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে নদীর দুই তীরে ভাঙন দেখা দিয়েছে। পৌলী নদীর বাঁ তীরে কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পৌরসভা ও সহদেবপুর ইউনিয়ন এবং ডান তীরে সদর উপজেলার আওতায় গালা ও ঘারিন্দা ইউনিয়ন। নদীর বাঁ তীরে (উত্তরাংশে) অর্থাৎ এলেঙ্গা পৌরসভার অংশে ভাঙনের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি। গত এক সপ্তাহের ভাঙনে এলেঙ্গা পৌরসভার ফটিকজানী ও মহেলা গ্রামের ৬০০ মিটার এলাকার আবাদি জমি এবং মহেলা গ্রামের সেকান্দর আলী ও তার ভাইদের আট-দশটি বাড়ি নদীগর্ভে চলে গেছে। নদীর ভাঙন চারান-লক্ষ্মীবাসা বিল উপ-প্রকল্পের বাঁধের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। বাঁধটি রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বাঁধের পাশেই মহেলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মহেলা মাদ্রাসা, মহেলা ঈদগাহ মাঠ ও গোরস্তান। চারান-লক্ষ্মীবাসা বিল উপ-প্রকল্পের বাঁধটি ভেঙে গেলে কালিহাতী উপজেলার পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় অপূরণীয় ক্ষতি হবে।
পৌলী নদীর ডান তীরে রেলব্রিজসংলগ্ন এলাকাটিও এলেঙ্গা পৌরসভার মহেলা আদর্শ গ্রাম (গুচ্ছগ্রাম) এবং টাঙ্গাইল সদর উপজেলার গালা ইউনিয়নের পাছবেথইর, আগবেথইর ও শালিনা গ্রামের অংশেও ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ৮০০ মিটার এলাকা বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের তীব্রতা বেড়ে বর্তমানে কম্পার্টমেন্টালাইজেশন পাইলট প্রকল্পের বাঁধ (টাঙ্গাইল শহর রক্ষা বাঁধ) ছুঁই-ছুঁই করছে। এ বাঁধটি ভাঙনের শিকার হলে টাঙ্গাইল শহর, গালা, ঘারিন্দা, করটিয়া ইউনিয়নসহ বাসাইল উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকার বাড়িঘর, ফসলি জমি, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা বিলীন হবে।
কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পৌরসভার ফটিকজানী গ্রামের বেলায়েত হোসেন, মহেলা গ্রামের মামুনুর রশিদ, আলতাফ মিয়াসহ অনেকেই জানান, শুকনো মৌসুমে নদীর তলদেশে বাংলা ড্রেজার বসিয়ে অবাধে বালু উত্তোলন করায় এখন নদীতীরের নিচের অংশ ধসে ভেঙে পড়ছে। নদীতে পানি আসার সময়ই পরিস্থিতি বিবেচনায় টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীকে বিষয়টি জানানো হয়েছিল। তিনি ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিলেও কোনো কার্যকারিতা দেখা যায়নি।
ফলে নদীর তীর ভাঙতে ভাঙতে চারান-লক্ষ্মীবাসা বিল উপ-প্রকল্পের বাঁধ কামান্না রাস্তার কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। বাঁধটি ভাঙনের শিকার হলে উপজেলার পূর্বাঞ্চলের ছয়টি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সদর উপজেলার গালা ইউনিয়নের পাছবেথইর গ্রামের আমীর আলী এবং পাছবেথইর গ্রামের বুজরত আলী, আবদুল বারেকসহ অনেকেই জানান, ভাঙন টাঙ্গাইল শহর রক্ষা বাঁধের খুব কাছে এসেছে। এখনই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নিলে টাঙ্গাইলের পূর্ব-দক্ষিণাঞ্চলের সর্বনাশ হবে।
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শাজাহান সিরাজ জানান, শহর রক্ষায় ৪৭ কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে। তবে এরই মধ্যে কিছু কিছু জায়গায় ভাঙন পরিলক্ষিত হচ্ছে। ভাঙনকবলিত গ্রামগুলোর মধ্যে মহেলা, পাছবেথর, রানাগাছা ও বার্থা অন্যতম। এসব এলাকায় স্থায়ী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা দাখিল করা হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদিত হলে স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। কেননা বর্তমানে তাদের কাছে কোনো বাজেট নেই। বাজেট না পেলে শুধু শুষ্ক কেন কোনো মৌসুমেই তাদের পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়।
জেলা প্রশাসক খান মো. নুরুল আমিন জানান, তিনি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন। পৌলী নদীর ভাঙন প্রতিরোধে দুই স্তরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বর্তমানে জরুরি প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও শুকনো মৌসুমে স্থায়ী প্রতিরোধ ব্যবস্থা রয়েছে, কেননা টাঙ্গাইল শহর রক্ষা বাঁধ ভেঙে গেলে টাঙ্গাইল শহরসহ বিস্তীর্ণ এলাকা মারাত্মক দুর্যোগের সম্মুখীন হবে।