জি এম জয়, রংপুর: রংপুরে প্রতি বছরই জুনের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে বাজারে পাওয়া যায় অতি সুমিষ্ট আঁশহীন হাঁড়িভাঙ্গা আম। তবে এবার তীব্র দাবদাহের কারণে ১০ দিন আগেই বাজারে এসেছে বিষমুক্ত এই আম। চাষি ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, আবহাওয়ার বিরূপ আচরণে এ বছর হাঁড়িভাঙ্গা আম আগাম পেকেছে। এ কারণে জেলা প্রশাসন ও কৃষি অধিদপ্তরের অনুমতিক্রমে ২০ জুনের পরিবর্তে শনিবার (১০ জুন) থেকে বাজারে আম সরবরাহ শুরু করেছেন চাষিরা।
হাঁড়িভাঙ্গার মৌসুমে আমের সবচেয়ে বড় হাট বসে রংপুরের পদাগঞ্জ ও কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকায়। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। শনিবার (১০ জুন) সকাল থেকেই হাট শুরুর প্রথম দিনেই ক্রেতাদের সরব উপস্থিতিতে জমজমাট হয়ে উঠছে আমের বিকিকিনি। এছাড়া রংপুর সিটি বাজার, লালবাগ, মডার্ন মোড়, ধাপ বাজার, শাপলা চত্বরসহ নগরীর বিভিন্ন হাটবাজারে উঠতে শুরু করেছে এ আম। হাটবাজার ছাড়াও নগরীর বিভিন্ন অলিগলি ও মোড়ে মোড়ে ফেরি করে হাঁড়িভাঙ্গা আম বিক্রি করতে দেখা গেছে।
এদিকে ক্রেতারা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার আমের বাজারে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছেন তারা। আর ব্যবসায়ীরা বলছেন, হাঁড়িভাঙ্গার ভালো ফলন হওয়ায় অল্প লাভেই বেশি বিক্রির আশা করছেন তারা। তবে এ বছর হাঁড়িভাঙ্গা আমের ফলন ভালো হলেও অনাবৃষ্টি-অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে আমের আকার খুব বেশি বড় হয়নি।
আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছোট সাইজের হাঁড়িভাঙ্গা আমের মণ বিক্রি হচ্ছে ১১০০ থেকে ১৩০০ টাকা, মাঝারি সাইজের ১৪০০ থেকে ১৬০০ টাকা এবং বড় সাইজেরটা ১৭০০ থেকে ২০০০ টাকা। সেই হিসাব অনুযায়ী প্রতি কেজি হাঁড়িভাঙ্গা আম সর্বনি¤œ ৩০ টাকা থেকে ৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এবারে আমের বাজার ভালো যাবে বলে ধারণা করছেন আম ব্যবসায়ীরা।
পদাগঞ্জ এলাকার আম ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার আমের আকার কিছুটা ছোট হয়েছে। তবে ফলন আশানুরূপ। এবার আবহাওয়া পরিস্থিতি বিবেচনায় দশ দিন আগেই আম পাড়া শুরু হয়েছে।
বাস টার্মিনাল এলাকায় আম কিনতে আসা কামরুল হাসান টিটু বলেন, অপেক্ষায় ছিলাম কবে হাঁড়িভাঙ্গা আম বাজারে আসবে। আজকে হাঁড়িভাঙ্গা আম পাওয়া যাবে জেনে এখানে আম নিতে এসেছি। আমের দাম স্বাভাবিক রয়েছে। তবে আর একটু কম হবে মনে করেছিলাম। এই আমের স্বাদটা ভালো লাগে তাই পরিবারের সবাই বেশি করে খাওয়ার চেষ্টা করি।
অনলাইনে আম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হাঁড়িভাঙ্গা অনলাইন সর্ভিসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও তরুণ উদ্যোক্তা সরকার মনজুরুল মান্নান বলেন, কয়েক বছর ধরে অনলাইনে আমের অর্ডার নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে তা সরবরাহ করছি। এবার শুরুর দিনেই ৫ মণ আমের অর্ডার পেয়েছি।
এদিকে মিঠাপুকুর উপজেলার আখিরাহাট, খোড়াগাছ, পদগঞ্জ, মাঠেরহাট, বদরগঞ্জের গোপালপুর, নাগেরহাট, সর্দারপাড়া, রংপুর নগরের বড়বাড়ী, সদর উপজেলার সদ্যপুস্করণী ইউনিয়নের কাটাবাড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বিশাল বিশাল বাগানে সারি সারি আম গাছ। জনপ্রিয়তার কারণে এখন রংপুরের তারাগঞ্জ, নীলফামারীর সৈয়দপুর, সদর, দিনাজপুরের পার্বতীপুর, খানসামা, চিরিরবন্দরসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে এই আমের বাগান। ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে এসব বাগান।
রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা আমের যেমন খ্যাতি রয়েছে, তেমনি চাহিদাও তুঙ্গে। বিদেশেও রপ্তানি হয় এ আম। হাঁড়িভাঙ্গা চাষ করে অনেকে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় তড়িঘড়ি করে আম বিক্রি করায় ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন তারা।
টেকসই অর্থনীতির জন্য হিমাগার স্থাপন, আধুনিক আমচাষ পদ্ধতি বাস্তবায়ন, গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনসহ হাঁড়িভাঙ্গাকে জিআই পণ্য হিসেবে ঘোষণার দাবি জানান হাঁড়িভাঙ্গা আমের সম্প্রসারক আব্দুস সালাম সরকার।
তিনি বলেন, সরকার প্রধানের উদ্যোগে দেশ-বিদেশে হাঁড়িভাঙ্গা আম রপ্তানি শুরু হয়েছে। আমরা এতে খুশি। তবে আর একটু দৃষ্টি দিলেই হাঁড়িভাঙ্গাকে ঘিরেই এই অঞ্চলের অর্থনীতি আরও সচল হবে। এজন্য সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ, কৃষি বিপণন ও পরিবহন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা জরুরি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুরের উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডল বলেন, এবার রংপুরে প্রায় তিন হাজার ৫৩৫ হেক্টর জমিতে সব জাতের আমের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৯০৫ হেক্টর জমিতে রয়েছে হাঁড়িভাঙ্গা আম। যা গত বছরের চেয়ে ৪০ হেক্টর বেশি। আমের ফলন এবার গতবারের চেয়ে ভালো হওয়ায় প্রায় ৩৫ হাজার মেট্রিকটন আম উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আশা করছি উৎপাদিত আমের বিক্রি এবার ২৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
রংপুরের জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীন বলেন, চাষিদের আবেদনের প্রেক্ষিতে শনিবার থেকে হাঁড়িভাঙ্গা আম পাড়া শুরু হয়েছে। আম বাজারজাত করতে যাতে কোনো ধরনের অসুবিধা না হয়, তা জেলা প্রশাসন থেকে মনিটরিং করা হবে।
