১০০ কিমি হিল চ্যালেঞ্জ

চ্যালেঞ্জ নিতে চান? ইচ্ছে থাকলে একবার নিজেকে চ্যালেঞ্জ নিয়ে দেখুন। নিজেকে একবার প্রমাণ করুন। আমরা টেলিভিশনে অনেক চ্যালেঞ্জিং প্রোগ্রাম দেখে থাকি। নিজেকে সে জায়গায় কখনও চিন্তা করে দেখেছি কী? নিজের সাধ্য অনুযায়ী একটা চ্যালেঞ্জ নেওয়া যেতে পারে, তাই নয় কী?
আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বড় বড় রানিং ইভেন্ট দেখি। ম্যারাথন, আলট্রা ম্যারাথন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে কিন্তু আমাদের দেশে কোনো বড় রানিং ইভেন্ট হয় না। এ ধরনের ইভেন্টে অংশ নিতে যেতে হবে দেশের সীমানা পেরিয়ে অন্য দেশে। এ কারণে দেশের অভ্যন্তরে যেন বড় পরিসরে দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যায়, তা-ই আমাদের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা।
এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বন্ধু আরিফুল ইসলামকে নিয়ে একটি চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম। নিজেদের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ। এর নাম দিয়েছি, ‘১০০-কিমি-হিল-চ্যালেঞ্জ’। বান্দরবান জিরো পয়েন্ট থেকে আলীকদম পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ দুদিনে অতিক্রম করব। প্রথম দিনে ১২ ঘণ্টায় ৫০ ও দ্বিতীয় দিনে ১২ ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার।
এটি অফিসিয়ালি কোনো বড় আয়োজন নয়। কিন্তু এ প্রচেষ্টা আমাদের দেশে নতুন এবং লং ডিস্টেন্স রানারদের অনুপ্রাণিত করা, যেন বাংলাদেশে অনেক দৌড়বিদ তৈরি হয়। আমাদের এ প্রচেষ্টায় পাশে পেয়েছি ‘দ্য-গ্রেট-বাংলাদেশ-রান’ ও ‘পথের-প্যাঁচালি’ গ্রুপকে।
এখন মূল গল্পে ফিরছি। সবুজে মোড়ানো প্রাকৃতিক সৌর্ন্দয, অবারিত সবুজের সমারোহ, মেঘের খেলা ও মেঘ ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে হলে বান্দরবানের বিকল্প নেই। এমনটাই শুনে আসছি বহুদিন ধরে। এবার নিজেরাই মেঘের সঙ্গে খেলা করব। এটাই যেন চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছিল। তাই ২০১৮ সালের শেষের কয়েকটি দিন মেঘের সঙ্গে মিতালির ইচ্ছে জাগে।
২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ গিয়েছিলাম মেঘের সঙ্গে মিতালি ও নিজেদের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে। ওইদিন রাত সাড়ে ৯টায় আমাদের বাস বান্দরবানের উদ্দেশে যাত্রা করে। কনকনে শীতের রাতের দীর্ঘ ভ্রমণ আমাদের শেষ হয় ভোররাতে। ভোরের আলোর অপেক্ষা করছিলাম বান্দরবানের একটি যাত্রীছাউনিতে। ব্যাগ হাল্কা রাখার জন্য শীতের ভারী পোশাক নিইনি। তখন অনুভব করি, যারা রাস্তায় ঘুমায়, তাদের এই শীতের রাতে কতই না কষ্ট হয়!

প্রথম দিন
২৭ ডিসেম্বর ভোর ৬টা ২৫। বান্দরবান জিরো পয়েন্ট থেকে আমাদের যাত্রা শুরু। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা ঘন কুয়াশায় ঘেরা রাস্তা ধরে এগুতে থাকি কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে। বারবার মনে হচ্ছিল, আকাশে যাওয়ার সিঁড়ি পেয়ে গেছি! দেখা যাক আমরা আকাশের সীমানা কতটা ছুঁতে পারি।
নির্জন রাস্তায় হাঁটতে আমাদের একটু ভয় হচ্ছিল। কিন্তু চারদিকের নৈসর্গিক সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে যাই সব ভয় ফেলে। খানিক পর সূর্য ওঠে। মনে হলো আমাদের স্বাগতম জানাচ্ছে সূর্য। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা মিলনছড়ি পৌঁছাই; ততক্ষণে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বেশ ওপরে উঠে গেছি। মেঘগুলো আমাদের নিচে পড়ে গেছে। মনে হচ্ছে, মেঘের ওপরে হাঁটছি। এমন দৃশ্যে চোখ জুড়িয়ে যায়, সব ক্লান্তিও দূর হয়ে যায়।
সামনে এগুতে থাকি। ১৮ থেকে
২০ কিলোমিটার হাঁটার পরও কোনো খাবার দোকান তো দূরের কথা, এক গ্লাস পানিরও কোনো সন্ধান পাইনি। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। আরও অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই দীর্ঘ পথে একজন মানুষেরও দেখা পাইনি। সুনসান রাস্তা ধরে দুজন হেঁটে চলেছি।
হাঁটছি আর খাবারের সন্ধান করছি। অবশেষে অমাবস্যায় পূর্ণিমার চাঁদের মতো একটা বড়ই গাছ দেখতে পাই। আর দেরি না করে কতগুলো জংলি বড়ই পেড়ে নিই। দুজনে খেয়ে আবার হাঁটা শুরু। কিছুদূর এগোনোর পর টহলরত সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে কথা হয়। তারা আমাদের উদ্দেশ্যকে স্বাগতম জানান। পরে একটা দোকানের সন্ধান পাই। বিস্কুট, মুড়ির মোয়া ও চা ছাড়া আর কিছু নেই। ক্ষুধার কারণে তা-ই অমৃত মনে করে খেয়ে নিই। আবার হাঁটা শুরু।
সকাল পেরিয়ে দুপুর প্রায়। এর মধ্যে আমরা চিম্বুক পাহাড় অতিক্রম করি। ‘বাংলার দার্জিলিং’খ্যাত এই চিম্বুক। বান্দরবান জেলা শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে চিম্বুক পাহাড়ের অবস্থান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় দুই হাজার ৫০০ ফুট। চিম্বুকে যাওয়ার রাস্তার দু’পাশের পাহাড়ি দৃশ্য খুবই মনোরম। পাহাড়ের মাঝের সড়ক দিয়ে এঁকেবেঁকে যাওয়ার সময় মনে হবে সিঁড়ি বেয়ে বুঝি চাঁদের বুকে পাড়ি জমাচ্ছি। পথে আমরা একটি ছোট বাজার থেকে কলা, পেঁপে, মিষ্টি বড়ই খেলাম।
এর আগে আরিফ সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে এ পথে। তার পরিচিত পথ; তবুও এত সুন্দর দৃশ্য এর আগে না কি উপভোগ করেনি সে। এরই মধ্যে আমাদের প্রায় ৪২ কিলোমিটার পথ অতিক্রম শেষ। কিছুক্ষণ বিরতি নিই। তখন প্রায় বিকাল ৪টা। আবার হাঁটা শুরু…।
নীলগিরি পৌঁছানোর সময় ৪৭ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করি। বাকি মাত্র তিন কিলোমিটার। প্রথম দিনের লক্ষ্যের একেবারে কাছে। নীলগিরি অতিক্রম করে সামনের দিকে এগুতে থাকি। দেড় কিলোমিটার আগানোর পর চার-পাঁচজন লোক আমাদের পিছু নেয়। তারা আমাদের নানা প্রশ্ন করতে থাকে। তাদের আচরণ একটু বেখাপ্পা মনে হয় আমাদের। তাই আমরা নীলগিরিতে ফিরে আসি। বিকাল ৫টার মধ্যেই আমাদের ৫০ কিলোমিটার পথ শেষ হয় নীলগিরিতে।
নীলগিরি থেকে গাড়ি নিয়ে আমরা থানচি চলে যাই। থানচি বাজারের একটি হোটেলে দুজনে আট প্লেট ভাত খেয়ে নিই। থানচির একটি হোটেলে আমরা রাত যাপন করি।
প্রথম দিনে ৫০ কিমি অতিক্রম করতে সময় লেগেছে আট ঘণ্টা ৫৭ মিনিট। একের পর এক উঁচু পাহাড়, মেঘের খেলা, পাখির কিচিরমিচির, বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ আমাদের বিমোহিত করে তোলে। সৌন্দর্যের অনুপম নিদর্শন যেন বান্দরবান।

দ্বিতীয় দিন
২৮ ডিসেম্বর ২০১৮। প্রচণ্ড ক্লান্ত ছিলাম। তাই যেন ঘুম ভাঙতেই চাইছিল না সেদিন। মোবাইল ফোনে অ্যালার্ম বাজছিল সেই ভোর ৫টা থেকে। মনে হচ্ছিল কেউ আমাদের
হাত-পা বেঁধে রেখেছে।
উঠতে উঠতে ৬টা বাজল। তাড়াহুড়ো করে বের হতে হতে ৬টা ৩০ বেজে গেছে। থানচি হোটেল থেকে এবার যাত্রা শুরু। যেহেতু দুজনের শরীরের অবস্থাই খারাপ, তাই কচ্ছপ গতিতেই আমাদের যাত্রা শুরু হলো।
কনকনে শীত, তার মধ্যে ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে আমরা দুজন হেঁটে চলেছি। শীতের স্নিগ্ধ সকাল, সবুজ পাহাড়ে মেঘেদের খেলা। প্রকৃতির এই অপরূপ রূপসুধা উপভোগ করতে থাকি। চার-পাঁচ কিলোমিটার অতিক্রমের পর চোখের সামনে দৃশ্যমান হলো আকাশচুম্বী উঁচু পাহাড়।
আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। থানচি-আলীকদম আঞ্চলিক সড়ক বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু রাস্তা। আমরা দুই বন্ধু সেই উঁচু রাস্তা জয় করতে এগিয়ে যাচ্ছি। চলতে চলতে এক সময় আমাদের পা আর চলতে চায় না। পিপাসায় কাতর হয়ে পড়ি। আমাদের পানিও শেষ তখন। চারপাশের কোথাও পানি পেলাম না। শীতকাল হওয়ায় এলাকার ঝরনাগুলোয় পানি নেই। তাই পাহাড়ি রাস্তায় দুজনেই শুয়ে পড়ি। পুরো অঞ্চলটি যেন নীরবতার চাদরে ঢাকা।
চারপাশে বাতাসের মৃদু শব্দ। পাখির কিচিরমিচির আর পাহাড়ি কিছু পোকার শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। মনে হচ্ছিল এ পৃথিবীর বুকে আমরা দুই বন্ধু ছাড়া আর কেউ নেই। দেশের সবচেয়ে উঁচু রাস্তায় শীতল বাতাসে মেঘেদের বুকে গা মেলে শুয়ে থাকার মধ্যে যে কী অনুভূতি তা আর নাই-বা বলি।
সব ক্লান্তি ভুলে আবার পথচলা শুরু। দুপুরের মধ্যে ডিম পাহাড়ের বুকে আমাদের পদচিহ্ন এঁকে দিই। এ পাহাড়টি আলীকদম ও থানচি উপজেলার ঠিক মাঝখানে। এ পাহাড় দিয়েই দুই উপজেলার সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। পাহাড়টির মধ্য দিয়ে সমুদ্র সমতল থেকে আড়াই হাজার ফুট উঁচুতে নির্মাণ করা হয়েছে দেশের সবচেয়ে উঁচু সড়কপথ। এ পাহাড়চূড়ার আকৃতি দেখতে ডিমের মতো হওয়ায় স্থানীয়রা একে ‘ডিম পাহাড়’ নামেই চেনে।
দেখতে দেখতে ৩৭ কিলোমিটার অতিক্রম করে ফেললাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পর আমরা একটি বাজারে পৌঁছাই। ততক্ষণে আমাদের ৪৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া শেষ। এলাকাবাসী আমাদের স্বাগতম জানাল। তাদের মিশনের কথা বলি। আমাদের ঘিরে তাদের কৌতূহল ছিল চোখে পড়ার মতো। মুহূর্তটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
স্থানীয় হোটেল থেকে খাবার খেয়ে নিই। মনে হচ্ছিল কয়েক বছর পর ভাত খাচ্ছি!
খাওয়ার পর বিরতি নিয়ে আবার যাত্রা করি। বিকাল ৪টার মতো বাজে। বাকি সাত কিলোমিটার পথ। কিছুক্ষণের মধ্যে লক্ষ্যে পৌঁছে যাব। তবে হোটেল থেকে বের হয়ে যাত্রা করতেই পা আর চলছিল না। তাই বসে পড়ি রাস্তার পাশে। অনেকক্ষণ ম্যাসেজ করে লাঠির ওপর ভর করে চলতে থাকি। সন্ধ্যার মধ্যে শেষ করতে হবে পাহাড়ি রাস্তা। আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছি। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। সূর্যিমামা ধীরে অস্ত যাচ্ছে। এদিকে আমাদের জয়ের সূর্যও উঁকি দিচ্ছে। দুজনের পায়ের অবস্থা ভালো নেই; কিন্তু আমরা দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছি।
সন্ধ্যা ৫টা ৫৮ মিনিটে আমাদের মিশন ‘১০০-কিমি-হিল-চ্যালেঞ্জ’ শেষ করি। ৯ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট লেগেছে দ্বিতীয় সেশন শেষ করতে। ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল। এটা আমাদের দুজনের প্রথম ‘হিল চ্যালেঞ্জ’। সব সময় যারা উৎসাহ জুগিয়েছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ আমরা।

সাইফুল ইসলাম শান্ত