নিজস্ব প্রতিবেদক:পোশাক রপ্তানিতে জালিয়াতি থেমে নেই। কখনও অন্য প্রতিষ্ঠানের ইএক্সপি ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার কখনও স্যাম্পল বা নমুনা ঘোষণা দিয়ে পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। জালিয়াতি করে রপ্তানি করা এসব পণ্যের টাকা দেশে আসে না। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে অভিনব কায়দায় জালিয়াতি করা এমন ১০টি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এসব প্রতিষ্ঠান রপ্তানির আড়ালে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা পাচার করেছে বলে প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। গতকাল সোমবার শুল্ক গোয়েন্দার যুগ্ম পরিচালক শাসমুল আরেফিন খান এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানিয়েছেন, বর্তমানে চলমান অনিয়মের তদন্তকালে ১০টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বিগত সময়ে ১ হাজার ২৩৪টি পণ্য চালানে এমন জালিয়াতি করেছে মর্মে প্রমাণ পাওয়া গেছে। রপ্তানি সম্পন্ন ১ হাজার ২৩৪টি চালানের বিপরীতে পণ্যের পরিমাণ ৯ হাজার ১২১ মেট্রিক টন; যার প্রত্যাবাসনযোগ্য বৈদেশিক মুদ্রার সম্ভাব্য পরিমাণ ৩ কোটি ৫৩ লাখ ৬৬ হাজার ৯১৮ মার্কিন ডলার; যা বাংলাদেশি প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্ট দলিলাদি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানগুলো টি-শার্ট, টপস, লেডিস ড্রেস, ট্রাউজার, বেবি সেট, পলো শার্টসহ নানা ধরনের পণ্য সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কাতার, সৌদি আরব, নাইজেরিয়া প্রভৃতি দেশে জালিয়াতির মাধ্যমে রপ্তানি দেখিয়ে অর্থ পাচার করেছে। ১০টি প্রতিষ্ঠান মূলত বিল অব এক্সপোর্টে ‘ন্যাচার ট্র্যানজেকশন’-এ কোড ২০ ব্যবহার করে জালিয়াতি করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো প্রজ্ঞা ফ্যাশন লিমিটেড, ফ্যাশন ট্রেড, এমডিএস ফ্যাশন, হংকং ফ্যাশনস লিমিটেড, থ্রি-স্টার ট্রেডিং, ফরচুন ফ্যাশন, অনুপম ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেড, পিক্সি নিট ওয়্যারস লিমিটেড, স্টাইলাইজ বিডি লিমিটেড ও ইডেন স্টাইল টেক্স।
শাসমুল আরেফিন আরও বলেন, এর আগেও ৪টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একই পন্থায় ৩৭৯ কোটি টাকা পাচারের ঘটনা উদঘাটন করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং অনুসন্ধানসহ ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ৬৭৯ কোটি টাকা পাচারের ঘটনা উদঘাটন করল কাস্টমস গোয়েন্দা।
শুল্ক গোয়েন্দা জানায়, রপ্তানি জালিয়াতির মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য চালান বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে, কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা প্রত্যাবাসিত হচ্ছে না এমন একটি অভিযোগ শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর তদন্ত অধিদপ্তরের কাছে ছিল। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বিল অব এক্সপোর্ট জালিয়াতি করে অন্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ ব্যাংকের এক্সপোর্ট মনিটরিং সিস্টেম (ইএক্সপি) ব্যবহার করে পণ্য রপ্তানি করেছে। যার বিপরীতে কোনো অর্থ দেশে ফিরে আসেনি বা সমুদয় রপ্তানি মূল্য বাবদ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে।
প্রজ্ঞা ফ্যাশন: সাভারের আশুলিয়ায় অবস্থিত প্রজ্ঞা ফ্যাশন লিমিটেড ২০১৯ সালে ৩৮৩টি ও ২০২০ সালে ৮টিসহ ৩৯১টি রপ্তানি চালানের মাধ্যমে অর্থ পাচার করেছে। রপ্তানি করা পণ্য চালানগুলোয় ৩ হাজার ৮০ মেট্রিক টন টি-শার্ট, প্যান্ট, ট্যাংক-টপ, পায়জামা প্রভৃতি পণ্য সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে। রপ্তানি করা পণ্যের মূল্য প্রায় ১ কোটি ৮ লাখ ৪১ হাজার ৬৯৯ মার্কিন ডলার বা ৯২ কোটি ৪ লাখ ৬০ হাজার ২৪৫ টাকা। প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট চট্টগ্রামের কোম্পানি এমএজে শিপিং করপোরেশন, রিয়াংকা ইন্টারন্যাশনাল, এঅ্যান্ডজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, জেজে অ্যাসোসিয়েট ও এক্সপ্রেস ফরোয়ার্ডারস।
ফ্যাশন ট্রেড: রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালে ৭৩টি, ২০১৯ সালে ১১৬ ও ২০১৮ সালে ৫৭টিসহ ২৪৯ রপ্তানি চালানে জালিয়াতি করেছে বলে প্রমাণ মিলেছে। রপ্তানি করা পণ্য চালানগুলোয় ১ হাজার ৭৭৯ মেট্রিক টন টি-শার্ট, প্যান্ট, ট্যাংক-টপ, পায়জামা প্রভৃতি পণ্য সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ফিলিপাইন, নাইজেরিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, সুদান, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে। রপ্তানি করা পণ্যের মূল্য প্রায় ৮০ লাখ ৫১ হাজার ৬৪০ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ৬৮ কোটি ৩৫ লাখ ৮৪ হাজার ২৩৬ টাকা। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের নাম এমজে শিপিং করপোরেশন, রিয়াংকা ইন্টারন্যাশনাল এবং এঅ্যান্ডজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল।
এমডিএস ফ্যাশন: রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত এমডিএস ফ্যাশন নামে প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালে ১৮২টি রপ্তানি চালানে জালিয়াতি করেছে প্রমাণ পাওয়া গেছে। রপ্তানি করা পণ্য চালানগুলোয় ১ হাজার ৩৭৬ মেট্রিক টন টি-শার্ট সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, কাতার ও ফিলিপাইন রপ্তানির কথা বলেছে; যার মূল্য প্রায় ৫১ লাখ ৮২ হাজার ৫৮৬ মার্কিন ডলার বা ৪৪ কোটি ১ হাজার ৫৫১ টাকা। এই প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট হলো চট্টগ্রামের এঅ্যান্ডজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, জি আর ট্রেডিং করপোরেশন ও পান বেঙ্গল এজেন্সি।
হংকং ফ্যাশনস: গাজীপুরের টঙ্গীতে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২০ সালে ১৫৬টি রপ্তানি চালানে জালিয়াতি করেছে। তারা ১ হাজার ৯৬১ মেট্রিক টন টি-শার্ট রপ্তানি করার কথা বলেছে। অধিকাংশ পণ্য চালান সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, কাতার, নাইজেরিয়া, কুয়েত, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে রপ্তানির মাধ্যমে ৪৭ লাখ ৮৯ হাজার ৬০৬ মার্কিন ডলার বা ৪০ কোটি ৬৬ লাখ ৩৭ হাজার ৫৮৬ টাকা পাচার করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এমএজে শিপিং করপোরেশন, পান বেঙ্গল এজেন্সি, পরাগ এসএমএস লিমিটেড, রিয়াংকা ইন্টারন্যাশনাল ও একে ইন্টারন্যাশনাল।
থ্রি-স্টার ট্রেডিং: রাজধানীর বনানীতে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি ২০১০ সালে ১২০টি রপ্তানি চালানে জালিয়াতি করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। রপ্তানি করা পণ্য চালানগুলোয় ৮১৬ মেট্রিক টন টি-শার্ট রপ্তানি করে। মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, কানাডা, মিসর প্রভৃতি দেশে রপ্তানির নামে ৩০ লাখ ৫৩ হাজার ১০৮ মার্কিন ডলার বা ২৫ কোটি ৯২ লাখ ৮ হাজার ৮৬৯ টাকা। রপ্তানি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট হলো জি আর ট্রেডিং করপোরেশন, পান বেঙ্গল এজেন্সি, আরএসসি অ্যান্ড এফ লিমিটেড ও এঅ্যান্ডজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল।
ফরচুন ফ্যাশন: রাজধানীর মিরপুরের ঠিকানার প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ এবং ২০১১ সালে ৫৯টি রপ্তানি চালানে জালিয়াতি করেছে। ৪৩৫ টন টি-শার্ট সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, মিসর, কানাডা প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করে ১৫ লাখ ২৪ হাজার ৮১৩ মার্কিন ডলার বা ১২ কোটি ৯৪ লাখ ৫৯ হাজার ৬২৩ টাকা পাচার করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট রিয়াংকা ইন্টারন্যাশনাল, এঅ্যান্ডজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও এম/এস এ. কে এন্টারপ্রাইজ।
অনুপম ফ্যাশন ওয়্যার: রাজধানীর কচুক্ষেতের ঠিকানাধারী প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালে ৪২টি রপ্তানি চালানের মাধ্যমে অর্থ পাচার করেছে। পণ্যচালানগুলোয় ১৯৫ টন টি-শার্ট সংযুক্ত আরব আমিরাত, বেলজিয়াম, নাইজেরিয়া, জর্জিয়া, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে রপ্তানির বিপরীতে প্রায় ৮ লাখ ৭৭ হাজার ৪৭০ মার্কিন ডলার বা ৭ কোটি ৪৪ লাখ ৯৭ হাজার ২০০ টাকা পাচার করেছে। জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট হলো পান বেঙ্গল এজেন্সি, এঅ্যান্ডজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, জে জে অ্যাসোসিয়েট, জি আর ট্রেডিং করপোরেশন ও এনএইচ করপোরেশন।
পিক্সি নিট ওয়্যারস: গাজীপুরের টঙ্গীতে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালে ২০টি রপ্তানি চালানে জালিয়াতি করে ১৭০ মেট্রিক টন টি-শার্ট রপ্তানি করে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কাতার, কুয়েত, ফিলিপাইন, নাইজেরিয়া, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশে রপ্তানি দেখিয়ে ৫ লাখ ৯৬ হাজার ২৮২ মার্কিন ডলার বা ৫ কোটি ৬ লাখ ২৪ হাজার ৩৪১ টাকা পাচার করেছে। জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট হলো জিআর ট্রেডিং করপোরেশন ও এনএইচ করপোরেশন।
স্টাইলাইজ বিডি: রাজধানীর শাহবাগের ঠিকানা ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালে ১০টি রপ্তানি চালান জালিয়াতি করে ৬৬.৮ মেট্রিক টন টি-শার্ট রপ্তানি করে। অধিকাংশ পণ্য চালান ফ্রান্স, কানাডা, রাশিয়া, সেøাভেনিয়া, পানামা প্রভৃতি দেশে রপ্তানির বিপরীতে প্রায় ২ লাখ ৫৫ হাজার ৬২৯ মার্কিন ডলার বা ২ কোটি ১৭ লাখ ২ হাজার ৯০২ টাকা পাচার করেছে। জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট হলো জিআর ট্রেডিং করপোরেশন, পান বেঙ্গল এজেন্সি ও কেআরএসসি অ্যান্ড এফ লিমিটেড।
ইডেন স্টাইল টেক্স: রাজধানীর খিলক্ষেতে ঠিকানা ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটি ২০১০ সালে ৮টি রপ্তানি চালানে জালিয়াতি করেছে। ৪২ মেট্রিক টন টি-শার্ট ওমান, ব্রুনাই, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করে প্রায় ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮৫ মার্কিন ডলার বা ১ কোটি ৬৪ লাখ ৭৭ হাজার ৮১৬ টাকা পাচার করেছে। রপ্তানি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট হলো জিআর ট্রেডিং করপোরেশন, পান বেঙ্গল এজেন্সি ও কেআরএস সিঅ্যন্ডএফ লিমিটেড।