রেন্টাল-কুইক রেন্টাল ও আইপিপি

১২ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ গেছে ৮৬ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা

বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা প্রতি বছর বাড়লেও বড় অংশই বসে থাকছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ থেকে প্রচুর আয় করেছে বিনিয়োগকারী কোম্পানিগুলো। সাম্প্রতিক বিদ্যুৎ খাতের সংকটে নতুন করে আলোচনায় আসে ক্যাপাসিটি চার্জ। তাই গত এক যুগে এ খাতে সরকারের ব্যয় ও কোম্পানিগুলোর আয় নিয়ে অনুসন্ধান করেছে শেয়ার বিজ। এ নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের আজ ছাপা হচ্ছে প্রথম পর্ব

ইসমাইল আলী: বিদ্যুৎ সংকট মেটাতে ২০০৯ সাল থেকেই বেসরকারি খাতকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে সরকার। প্রথমে তিন ও পাঁচ বছরের জন্য বেশকিছু রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হলেও পরে এগুলোর মেয়াদ বেড়েছে দফায় দফায়। পাশাপাশি ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) নামে বড় ও মাঝারি বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনেরও অনুমোদন দেয় সরকার। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে।

যদিও এসব কেন্দ্রের বড় অংশই বসে থাকছে। তবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) প্রতি বছর মোটা অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হচ্ছে। সংস্থাটির হিসাব বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১০-১১ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ১২ বছরে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জই পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় ৮৬ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক যুগে প্রায় তিনটি পদ্মা সেতুর নির্মাণব্যয়ের সমান অর্থ গেছে এ খাতে।

গত ১২ বছরে দেশে বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে ৩০ হাজার ৩৫৭ কোটি ২০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। এজন্য পিডিবিকে বিল পরিশোধ করতে হয় দুই লাখ ৩২ হাজার ৭৮৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ গেছে ৩৭ দশমিক ২৩ শতাংশ।

পিডিবির তথ্যমতে, গত ১৪ বছরে বেসরকারি খাতে প্রায় ১০০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র দরপত্রের মাধ্যমে নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়। যদিও একটি কোম্পানি অংশ নেয়ায় তাতেও কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না। ফলে বেশি দরে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের লাইসেন্স পায় সামিট। বাকি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল আনসলিসিটেড তথা অযাচিত প্রস্তাবের মাধ্যমে। ফলে এগুলো ক্যাপাসিটি চার্জ অনেক বেশি ধরা হয়েছে।

পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১০-১১ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা ছিল তিন হাজার ১৬২ মেগাওয়াট। তবে সক্ষমতার ব্যবহার হয়েছিল ৫৪ শতাংশ। সে সময় বেসরকারি খাত থেকে কেনা হয় এক হাজার ৪৮৪ কোটি ১৬ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। এতে ব্যয় হয় সাত হাজার ৫৭৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল দুই হাজার ৭৮৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, যা মোট ব্যয়ের ৩৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ।

পরের (২০১১-১২) অর্থবছরে বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা ছিল তিন হাজার ৫৮৩ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ব্যবহার হয় ৫৮ শতাংশ। সে অর্থবছর বেসরকারি খাত থেকে কেনা হয় এক হাজার ৮১৭ কোটি ৪৯ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। এতে ব্যয় হয় ১২ হাজার ৩০৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল পাঁচ হাজার এক কোটি ২৩ লাখ টাকা, যা মোট ব্যয়ের ৪০ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

২০১২-১৩ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা দাঁড়ায় তিন হাজার ৬৮৫ মেগাওয়াট। সে অর্থবছর সক্ষমতার ব্যবহার হয় ৫৮ শতাংশ। সে বছর বেসরকারি খাত থেকে কেনা হয় এক হাজার ৮৬২ কোটি পাঁচ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। এতে ব্যয় হয় ১৪ হাজার ৯০ কোটি ২০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল পাঁচ হাজার ৪৯০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, যা মোট ব্যয়ের ৩৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ।

২০১৩-১৪ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা চার হাজার মেগাওয়াট ছাড়ায়। সে সময় এ সক্ষমতার ব্যবহার হয় ৫২ শতাংশ। সে অর্থবছর বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয় এক হাজার ৮৬৩ কোটি ২৫ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে ব্যয় হয় ১৪ হাজার ২১৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা, যার মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল চার হাজার ৭১৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, যা মোট ব্যয়ের ৩৩ দশমিক ১৭ শতাংশ।

২০১৪-১৫ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় চার হাজার ৪৪৮ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ব্যবহার হয় ৫০ শতাংশ। সে অর্থবছর বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয় এক হাজার ৯৫৪ কোটি ৫২ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে ব্যয় হয় ১৪ হাজার ৯০৬ কোটি ১১ লাখ টাকা। আর ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল চার হাজার ৬৬৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা, যা মোট ব্যয়ের ৩১ দশমিক ২৯ শতাংশ।

তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা পাঁচ হাজার মেগাওয়াট ছাড়ায়। এর মধ্যে ব্যবহার হয় ৫৩ শতাংশ। সে অর্থবছর এ খাত থেকে দুই হাজার ৪১৩ কোটি ৬৪ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ কেনা হয়। এতে ব্যয় হয়েছিল ১৪ হাজার ১৭ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ পাঁচ হাজার ৩৭৬ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। মোট ব্যয়ের মধ্যে এর হার ছিল ৩৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা ছিল পাঁচ হাজার ৪৫৯ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ব্যবহার হয়েছে ৫১ শতাংশ। এ খাত থেকে সে সময় কেনা হয়েছিল দুই হাজার ৪৪৫ কোটি ২৮ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। এতে ব্যয় হয় ১৪ হাজার ৭৩৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ পরিশোধ করা হয় পাঁচ হাজার ৭৬৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, যা উৎপাদন ব্যয়ের ৩৯ দশমিক ১২ শতাংশ।

২০১৭-১৮ অর্থবছর বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ২১৩ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ ব্যবহার হয়। বেসরকারি এসব কেন্দ্র থেকে ওই অর্থবছর কেনা হয় দুই হাজার ৫২৩ কোটি ৩৪ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। এতে ব্যয় হয় ১৬ হাজার ৬৯২ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ছয় হাজার ২৪১ কোটি ২৫ লাখ টাকা, যা উৎপাদন ব্যয়ের ৩৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

এর পরের (২০১৮-১৯) অর্থবছর বেসরকারি খাতের সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৭৪১ মেগাওয়াট। বেসরকারি এসব কেন্দ্রের সক্ষমতা ব্যবহার হয় ৫৪ শতাংশ। এতে বেসরকারি খাত থেকে কেনা হয় দুই হাজার ৭১৩ কোটি ৩০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। এতে ব্যয় হয় ২০ হাজার ৭৮১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জই ছিল আট হাজার ৭২২ কোটি ২৭ লাখ টাকা, যা উৎপাদন ব্যয়ের প্রায় ৪২ শতাংশ।

২০১৯-২০ অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় আট হাজার ৪১১ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ৩৯ শতাংশ ব্যবহার হয়। মূলত করোনাকালীন উৎপাদন অনেকটা কমে গিয়েছিল। সে অর্থবছর বেসরকারি খাত থেকে কেনা হয় দুই হাজার ৮৮৬ কোটি ৭৬ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। এতে ব্যয় হয় ২০ হাজার ৫৫৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় ১০ হাজার ৮৫২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা, যা উৎপাদন ব্যয়ের প্রায় ৫২ দশমিক ৮০ শতাংশ।

২০২০-২১ অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৭৩৪ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ৪৬ শতাংশ ব্যবহার হয়। সে অর্থবছর বেসরকারি খাত থেকে কেনা হয় তিন হাজার ৯০৫ কোটি ৯৭ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। এতে ব্যয় হয় ৩১ হাজার ১৬৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জই ছিল ১৩ হাজার ২১ কোটি তিন লাখ টাকা, যা উৎপাদন ব্যয়ের প্রায় ৪১ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

এদিকে গত জুনে শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৫৩৪ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ ব্যবহার হয়েছে। এতে গত অর্থবছর বেসরকারি খাত থেকে কেনা হয় চার হাজার ৪৮৭ কোটি ২৬ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। এতে ব্যয় হয় ৫১ হাজার ৭৪৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জই ছিল ১৪ হাজার ৩৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।

ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম. শামসুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, বাংলাদেশে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় নির্ধারণের কোনো নির্দিষ্ট ফরম্যাট অনুসরণ করা হয়নি। দরকষাকষির মাধ্যমে এসব কেন্দ্রের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতার ৮০% ব্যবহার হবে, এমন শতেই ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা হয়। যদিও প্রকৃতপক্ষে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে সক্ষমতার অর্ধেকের কিছু বেশি। তবে সক্ষমতা পুরো ব্যবহার না হলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে পুরোটাই। এতে দুই ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। একদিকে বেসরকারি কেন্দ্রগুলো বসে থাকছে। অপরদিকে সরকারের ব্যয়ের বোঝা বাড়ছে। তাই জ্বালানি সংকটের এ সময়ে এসব চুক্তি সংশোধন করে সরকারের ব্যয় সাশ্রয়ের উদ্যোগ নেয়া উচিত।