Print Date & Time : 28 August 2025 Thursday 5:31 am

১৩ বছরেও পূর্ণতা পায়নি সোনাহাট স্থলবন্দর

আমানুর রহমান খোকন, কুড়িগ্রাম : ১৩ বছরেও পুরোপুরি চালু হয়নি কুড়িগ্রামের সোনাহাট স্থলবন্দর। শুধু দুটি পণ্য আমদানির ওপর ভিত্তি করে কোনোরকমে টিকে আছে দেশের এই ১৮তম স্থলবন্দরটি। বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বন্ধে হতাশ ব্যবসায়ীরা। এতে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এখন মানুষ পারাপারের ইমিগ্রেশনসহ অনুমোদিত সব পণ্যের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম পুরোদমে সচলের দাবি সোনাহাট স্থলবন্দরের হাজারো ব্যবসায়ীর।

জানা যায়, দেশের সীমান্ত ঘেঁষা কুড়িগ্রাম জেলা শহরের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে স্থলবন্দরটি অবস্থিত। দরিদ্রপ্রবণ জেলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে ভারত-বাংলাদেশের পণ্য আমদানি-রপ্তানির জন্য ২০১৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোর প্রবেশপথে সোনাহাট স্থলবন্দর চালু করা হয়। যাতে করে কুড়িগ্রাম জেলা দিয়ে বাংলাদেশি পণ্য এবং ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্য আসাম, মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম, অরুণাচল, নাগাল্যান্ড এবং ত্রিপুরা রাজ্য হয়ে ভারতীয় পণ্য আমদানি সহজ হয়। যার প্রেক্ষিতে কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারী উপজেলার বঙ্গ সোনাহাট ক্যাম্পের মোড়ে ১৪ দশমিক ৬৮ একর জমির ওপর ২০১৬ সালে সোনাহাট স্থলবন্দরের অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু করে বাংলাদেশ সরকারের নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে এই স্থলবন্দর এলাকায় ৬০০ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ওয়্যারহাউস, ৯৫ হাজার বর্গফুটের ওপেন স্টকইয়ার্ড, ৯৬ হাজার বর্গফুটের পার্কিং ইয়ার্ড, শ্রমিকদের জন্য দুটি বিশ্রামাগার, দ্বিতল ডরমিটরি এবং একটি প্রশাসনিক ভবন রয়েছে। এই বন্দরের জিরো পয়েন্ট থেকে আসামের কোচবিহারের দূরত্ব ৬৫ কিমি, মেঘালয় ৩৫০ কিমি, শিলং ৩৫০ কিমি এবং ভুটানের দূরত্ব ১৬০ কিমি। বর্তমানে এই বন্দরে উন্নতমানের অবকাঠামো এবং দুই দেশের দূরত্ব সবটাই অনুকূলে থাকলেও বন্দরের মূল উদ্দেশ্য ভেস্তে যেতে বসেছে।

বন্দরে শুরু থেকেই ভারতীয় পাথর, কয়লা, তাজা ফল, ভুট্টা, গম, চাল, ডাল, আদা, পেঁয়াজ এবং রসুন এ দশটি পণ্য আমদানি করার অনুমোদন থাকলেও বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা সেই সুযোগ পায়নি। শুধু আমদানি করা হচ্ছে ভারতীয় পণ্য পাথর ও কয়লা। বাকি পণ্য আমদানির জন্য কোনো সুযোগ সৃষ্টি করেনি ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। এতে ভারতীয় সরকারও আশানুরূপ ভূমিকা রাখেনি। অপরদিকে, নিষিদ্ধ পণ্য ছাড়া বাংলাদেশের সব পণ্য রপ্তানির অনুমোদন থাকলেও দেশিও ব্যবসায়ীরা বন্দর নির্মাণের শুরু থেকেই তা থেকে বঞ্চিত ছিলেন। পরে বাংলাদেশের জুট ওয়েস্ট কটন, সিনথেটিক নেট, গার্মেন্টস পণ্য, আকিজের ফ্লাইউড এবং প্লাস্টিকের কিছু কিছু পণ্য রপ্তানি শুরু হয়েছিল। এতেই সোনাহাট স্থলবন্দরে বছরে গড়ে আয় হতো প্রায় ১৫ কোটি টাকা। এখন এই বন্দরের সব ধরনের রপ্তানি বন্ধ আছে। শুধু আমদানি হচ্ছে পাথর ও কয়লা। সেটিও নামমাত্র। গত এক সপ্তাহে এই বন্দরে গড়ে আমদানিকৃত পণ্য পাথরের ট্রাক এসেছে ২৫টি ও কয়লা এসেছে শুধু দুটি করে।

স্থায়ী ব্যবসায়ী আবুল হোসেন, রবিউল ইসলাম রাসেল বলেন, বন্দরের পরিবেশ অনেক ভালো থাকলেও আমরা শুরু থেকেই পাথর ও কয়লা ছাড়া অন্য কোনো পণ্য আমরা আমদানি করতে পারিনি। কিছু পণ্য রপ্তানি করতে শুরু করেছি, এরপরই রপ্তানি বন্ধ করা হয়েছে। এখনও আমরা এই বন্দর থেকে কোনো ব্যবসায়ী আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারিনি। পুরোদমে আমদানি-রপ্তানি শুরু হলে বন্দর এলাকার মানুষের অনেক কর্মসংস্থান হবে। ব্যবসাসহ আর্থিকভাবে লাভবান হবেন কয়েক হাজার মানুষ। আর শ্রমিক মিজু মিয়া, রফিকুল ইসলাম, রহিম উদ্দিন বলেন, আমরা বন্দরে মালামাল লোড-আনলোড করে জীবিকা নির্বাহ করি। ঢিলেঢালাভাবে বন্দর চলায় আামাদের বেকার থাকতে হয়। এতে পরিবারের খরচ চালাতে হিমশিম খাই। কুলসুম বেগম, সোমেনা বেওয়া বলেন, আমরা বন্দর এলাকার আশপাশের মানুষ শ্রমিকের কাজ করে জীবন বাঁচাই। রপ্তানি বন্ধ এবং অল্প আমদানি হওয়ার আমরা তেমন কাজ পাই না। সন্তানদের নিয়ে আমাদের অনাহারে থাকতে হয়।

সোনাহাট স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক এফেখারুল ইসলাম শ্যামা বলেন, ৫ আগস্টের পর সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এখানে প্রায় ২০০ ব্যবসায়ী যুক্ত আসেন। বন্দরে শুধু ভারতীয় পণ্য পাথর ও কয়লা আমদানি করা হয়। সেই আমদানিও বন্দর অনুপাতে অনেক কম। ব্যবসায়ীদের ভালো দিন যাচ্ছে না। আমরা এ বন্দরের অনুমোদিত সকল ভারতীয় পণ্য আমদানি করাসহ দেশিও সকল অনুমোদিত পণ্য রপ্তানি করতে চাই। সেই সাথে চাই মানুষ পারাপারের ইমিগ্রেশন। এতে করে আমরা যেমন লাভবান হবো, তেমনি লাভবান হবে সরকার ও দেশের সকল মানুষ।

সোনাহাট স্থলবন্দর কাস্টম ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম আকমল বলেন, এই বন্দরে আমরা ৫২ জন সিএনএফ এজেন্ট নিযুক্ত আছি। আমদানি-রপ্তানি তেমন না থাকায় বন্দরে ১০-১২জন এজেন্ট কাজ করছি। অনুমোদিত ভারতীয় ১০টি পণ্য এবং বাংলাদেশের অনুমোদিত সব পণ্য পুরোদমে আমদানি ও রপ্তানি শুরু হলে বন্দর জাঁকজমকভাবে চলবে। তাহলে সরকারের রাজস্ব আদায়ের সাথে সাথে বন্দরসহ আশপাশের হাজার হাজার মানুষ আর্থিকভাবে লাভবান হবেন।

সোনাহাট স্থল শুল্ক স্টেশন রাজস্ব কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, বন্দরে এখন শুধু গড়ে ২৫-২৬টি ট্রাক ভারতীয় পণ্য নিয়ে আসে। এখন রপ্তানি বন্ধ তাই কোনো কর্মব্যস্ততা নেই। আমরা আমদানিকৃত ভারতীয় পাথর ও কয়লার মাফ অনুযায়ী চালানের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করি। আমদানি-রপ্তানি বাড়লে বন্দরের ব্যবসা ও রাজস্ব বাড়বে।

এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক নুসরাত সুলতানা বলেন, বন্দর ভালো চললে সবাই উপকৃত হবেন। আমদানি-রপ্তানির বিষয়টি দুই দেশের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। সোনাহাট স্থলবন্দর পুরোপুরিভাবে সচল হলে এ অঞ্চলের সবাই আর্থিকভাবে লাভবান হবেন।