ইসমাইল আলী: বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ কয়েক বছর ধরে দ্রুত বাড়ছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সভরেন গ্যারান্টিযুক্ত বিদেশি ঋণ নিয়েছে, যা সরকারের প্রচ্ছন্ন দায় বাড়াচ্ছে। কোনো কারণে এসব সংস্থা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রকে সে দায় বহন করতে হবে। আবার বেসরকারি খাতেও বিদেশি ঋণ বাড়ছে লাফিয়ে। সব মিলিয়ে ১৩ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ প্রায় চারগুণ হয়েছে। বিদেশি ঋণ বাড়ায় তা পরিশোধের চাপও বাড়ছে। এতে ১৩ বছরের ব্যবধানে দেশের দীর্ঘমেয়াদি বিদেশি ঋণ শোধের পরিমাণ ৪৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এ ঋণের সুদ পরিশোধ বেড়েছে ৭৪৮ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের গতকাল প্রকাশিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ডেট রিপোর্ট ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে বিশ্বের সব দেশের ২০১০ থেকে ২০২৩ সালের বিদেশি ঋণ ও তা পরিশোধের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১০ সাল শেষে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ ছিল ২৬ দশমিক ৫৭২ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সাল শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০১ দশমিক ৪৪৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ১৩ বছরের ব্যবধানে দেশে বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৭৪ দশমিক ৮৭৫ বিলিয়ন ডলার বা ২৮২ শতাংশ। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বৃদ্ধির হার ছিল সবচেয়ে বেশি, যা মূলত বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা নিয়ে থাকে। এ ঋণের প্রায় পুরোটাই বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে নেয়া। তবে পরিমাণের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ, যা সরকার নিয়ে থাকে। এ ঋণের বেশিরভাগই সুদহার কম ও সহজ শর্তের।
গত কয়েক বছরের মধ্যে ২০২০ ও ২০২১ সালে দেশে বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। ২০১৯ সাল শেষে দেশে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬২ দশমিক ৪৬৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সাল শেষে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৭৩ দশমিক ৫৫১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ওই অর্থবছর বিদেশি ঋণ বেড়েছে ১১ দশমিক ০৮৩ বিলিয়ন ডলার বা ১৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণই বৃদ্ধি পায় ৯ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
পরের বছর বিদেশি ঋণ আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৯১ দশমিক ৪৭৮ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ২০২১ সালে দেশে বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি পায় ১৭ দশমিক ৯২৭ বিলিয়ন ডলার বা ২৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ওই বছর দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পায়। তবে বিদেশি ঋণের সুদহার কম পাওয়ায় বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ওই বছর সাত বিলিয়ন ডলারের বেশি বৃদ্ধি পায়। এতে ২০২১ সাল শেষে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ ১০ দশমিক ৯৮৬ বিলিয়ন থেকে ১৮ দশমিক ০৮৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। বৃদ্ধির হার ছিল ৬৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
যদিও পরের বছর আন্তর্জাতিক বাজারে সুদহার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ নেয়ার হার অনেকটাই হ্রাস পায়। এতে ২০২২ সালে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ বেড়েছিল মাত্র ৪৪২ মিলিয়ন ডলার। ওই বছর শেষে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৫২৮ বিলিয়ন ডলার। আর ২০২৩ সালে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেয়ার চেয়ে শোধ করার প্রবণতা ছিল বেশি। এতে গত বছর শেষে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ১৪ দশমিক ২৩১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত বছর এ ঋণ চার দশমিক ২৯৭ বিলিয়ন ডলার বা ২৩ দশমিক ১৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ২০১০ সালে এ ঋণের পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে ১৩ বছরে দেশের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেড়েছে ৬১ দশমিক ০৬২ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ২৭৫ শতাংশ। ২০১০ সালে এ ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ দশমিক ২২২ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৩ সালে বেড়ে হয়েছে ৮৩ দশমিক ২৮৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সাল শেষে দীর্ঘমেয়াদি বিদেশি ঋণে বেড়ে দাঁড়ায় ৭৫ দশমিক ৫০৯ বিলিয়ন ডলার, ২০২১ সালে যা ছিল ৭০ দশমিক ০৮৮ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া ২০২০ সাল শেষে দীর্ঘমেয়াদি বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬০ দশমিক ৪৫৫ বিলিয়ন ডলার ও ২০১৯ সাল শেষে ৫১ দশমিক ৩১৭ বিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে ১৩ বছরে আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) থেকে নেয়া ঋণ বা এসডিআর (স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস) বরাদ্দ বেড়ে প্রায় তিনগুণ হয়েছে। ২০২৩ সালে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন দশমিক ৯৩২ বিলিয়ন ডলার, ২০১০ সালে যা ছিল এক দশমিক ৪০৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বৃদ্ধির হার ১৮০ শতাংশ। ২০২০ সাল পর্যন্ত এসডিআর ৭০০ মিলিয়নের ঘরে থাকলেও, ২০২১ সালে তা এক লাফে দুই বিলিয়ন ছাড়ায়। পরের দুই বছর তা আর খুব একটা বাড়েনি। তবে ২০২২ সাল শেষে আইএমএফের ঋণ ৯৪১ মিলিয়ন থেকে গত বছর তা দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ায় এক দশমিক ৮৭৬ বিলিয়ন ডলার।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২৩ সাল শেষে সরকারি ও সভরেন গ্যারান্টিযুক্ত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৪ দশমিক ১৩১ বিলিয়ন ডলার, ২০১০ সালে যা ছিল ২১ দশমিক ১৪৬ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে সরকারের বিদেশি ঋণের ২৬ শতাংশ বিশ্বব্যাংক থেকে নেয়া হয়েছে, ২০ শতাংশ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং ১৫ শতাংশ জাপান সরকারের থেকে নেয়া হয়েছে। এর বাইরে সরকারের ঋণের ৯ শতাংশ চীন থেকে নেয়া, রাশিয়া থেকে নেয়া ৯ শতাংশ এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক উৎস থেকে নেয়া আট শতাংশ।
সব মিলিয়ে বর্তমানে সরকারের ঋণের গড় পরিশোধকাল দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৮ বছর, যার মধ্যে গ্রেস পিরিয়ড ছয় বছর। সহজ শর্তের ঋণগুলোয় গ্রেস পিরিয়ড ও পরিশোধকাল বেশি হলেও কঠিন শর্তের ঋণে তার উল্টো চিত্র। আর সরকারি ঋণের ভারিত গড় সুদহার বেড়ে আড়াই শতাংশ ছাড়িয়েছে। জাপানের ঋণের সুদহার সবচেয়ে কম। এছাড়া বিশ্বব্যাংক ও এডিবির ঋণের সুদহারও তুলনামূলক কম। তবে চীন ও রাশিয়ার ঋণের সুদহার অনেক বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদহার রাশিয়ার ঋণের।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১০ সালে দেশের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল এক বিলিয়ন ডলারের কম (মাত্র ৮২১ মিলিয়ন ডলার)। ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১০ সালের তুলনায় সাড়ে পাঁচগুণের বেশি। যদিও ২০২২ সালে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি পাঁচ দশমিক ১৪১ বিলিয়ন ডলার। তবে ২০২০ সালে এর পরিমাণ ছিল তিন বিলিয়ন ডলারের নিচে।
এদিকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সুদ পরিশোধের পরিমাণ ২০১০ সালে ছিল মাত্র ২০৩ মিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৭২১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ সুদ পরিশোধ ১৩ বছরে প্রায় সাড়ে আটগুণ হয়েছে। ২০২২ সালে সুদ পরিশোধ ব্যয় ছিল ১ দশমিক ০৩৭ বিলিয়ন ডলার। এর আগে তা এক বিলিয়ন ডলারের নিচেই ছিল। প্রসঙ্গত, ২০২৩ সাল শেষে মোট জাতীয় আয়ের ২২ শতাংশ দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ, যা ২০২২ সালে ছিল ২০ শতাংশ। আর গত বছর বিদেশি ঋণ পরিশোধ (ডেট সার্ভিসিং) দাঁড়িয়েছে জাতীয় আয়ের দুই শতাংশ, যা ২০২২ সালে ছিল এক শতাংশ।