আব্দুল হাকিম, রাজশাহী : সম্প্রতি ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের সনদ পেয়েছে নতুন ৭টি পণ্য। এ নিয়ে দেশে মোট ১৭টি জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেল। তবে ১৭ জিআই পণ্যের মধ্যে ৭টিই রাজশাহী বিভাগের। একক জেলা হিসেবে সর্বোচ্চ চারটি জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা। এছাড়া বগুড়ার দইসহ জিআই পণ্যের স্বীকৃতি মিলেছে নাটোরের কাঁচাগোল্লার। যা এ অঞ্চলের জন্য যেমন গর্বের তেমনি সম্ভাবনার। স্থানীয় প্রশাসন, গবেষক, চাষি ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের প্রচেষ্টায় একের এক জিআই স্বীকৃতিতে খুশি এ অঞ্চলের মানুষ।
জানা যায়, কোনো একটি দেশের মাটি, পানি, আবহাওয়া এবং ওই জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তাহলে সেটিকে ওই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। অর্থাৎ সেই পণ্য শুধু ওই এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও উৎপাদন করা সম্ভব নয়। কোনো পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেলে পণ্যগুলো বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করা সহজ হয়। পণ্যগুলোর আলাদা কদর থাকে। ওই অঞ্চল বাণিজ্যিকভাবে পণ্যটি উৎপাদন করার অধিকার এবং আইনি সুরক্ষা পায়। এরই ওপর ভিত্তি করে জিআই পণ্যের সনদ দেয়া হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেডমার্ক অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) বরাবর আবেদন, জার্নাল প্রকাশসহ দীর্ঘ পরিক্রমায় জিআই পণ্যের স্বীকৃতি মেলে। জিআই পণ্যের এ স্বীকৃতি তালিকায় রাজশাহী জেলার দুটি পণ্য রয়েছে। একটি ‘রাজশাহী সিল্ক’ অন্যটি রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ যৌথভাবে ফজলি আম। এছাড়া রাজশাহীর পানের জিআই স্বীকৃতি চেয়ে সম্প্রতি আবেদন করা হয়েছে। এটিরও খুব দ্রুতই স্বীকৃতি মিলবে বলে আশা করছেন তারা।
রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর বলেন, এক্সপোর্ট আইটেম যত বেশি হবে অর্থনীতি তত শক্তিশালী হবে। দেশ, অঞ্চল বা শহর জলবায়ু, সংস্কৃতির সঙ্গে অনন্য বৈশিষ্ট্য হলে তাদের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতির পায়। এ স্বীকৃতি রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ অঞ্চলের আরও বেশকিছু পণ্য আছে। পর্যায়ক্রমে সেগুলোও স্বীকৃতি মিলবে।
কয়েক জাতের আম নিয়ে রাজশাহী বিভাগের মধ্যে জিআই পণ্যের তালিকায় উপরে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এই জেলার জিআই পণ্যগুলো হলো- খিরসাপাত আম, ল্যাংড়া আম, আশ্বিনা আম। বগুড়ার দই ছাড়াও জিআই পণ্যের স্বীকৃতি মিলেছে নাটোরের কাঁচাগোল্লার।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম: রাজশাহী অঞ্চলের জিআই পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম। খিরসাপাত জাতের আমটি জিআই পণ্যের স্বীকৃতির জন্য ২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আবেদন করে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। এরপরে ২০১৯ সালের ২৭ জানুয়ারি জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পায় এটি। আমটি গোল ও মাঝারি আকৃতির। রসাল আমটির মূল বৈশিষ্ট্য হলো এটি আঁশহীন। আর গন্ধ বেশ আকর্ষণীয়। খিরসাপাত আম স্বাদে খুব মিষ্টি। এ আমের ফুল আসা থেকে ফল পরিপক্ব হতে দরকার হয় চার মাস। তবে গবেষকরা এ আমটি বারোমাস চাষ করা যায় কি না তা নিয়ে উচ্চতর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।
ফজলি আম: ২০১৭ সালের ৯ মার্চ ‘ফজলি আম’ জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি চেয়ে আবেদন করে রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্র। তবে ফজলি আম নিয়ে নিয়ে আপত্তি তোলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। সব বির্তক মাড়িয়ে ফজলি আম রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় ২০২২ সালের ২৯ মে। ফজলি আম দীর্ঘ এবং ঈষৎ চ্যাপ্টা। পাকা আমের খোসা কিছুটা হলুদ হয়ে ওঠে। শাঁস হলুদ, আঁশবিহীন, রসাল, সুগন্ধযুক্ত, সুস্বাদু ও মিষ্টি। আঁটি লম্বা, চ্যাপ্টা ও পাতলা। এ আমে শর্করার পরিমাণ ১৭.৫ শতাংশ। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বা জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে ফজলি আম পাকতে শুরু করে।
ল্যাংড়া আম: আমের তিন শতাধিক প্রজাতির মধ্যে ব্যতিক্রমী ল্যাংড়া। এ আমের স্বাদ ও গুণ অন্য সব আমের থেকে ব্যতিক্রম। ল্যাংড়াকে ফলের রাজাও বলা হয়। ২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আমকে জিআই পণ্যের স্বীকৃতির জন্য আবেদন করে আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র চাঁপাইনবাবগঞ্জ। ল্যাংড়া আম জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পায় ২০২৩ সালের ৫ জুলাই।
আশ্বিনা আম: ২০১৮ সালে পহেলা জানুয়ারি আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র চাঁপাইনবাবগঞ্জের আশ্বিনা আম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির আবেদন করে। ২০২৩ সালের ২৫ জুন আশ্বিনা আম জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পায়। অন্য সব আম গাছের সঙ্গে মুকুল আসে আশ্বিনার। তবে এ জাতের আম গাছে থাকে সাধারণত আগস্ট মাস পর্যন্ত।
রাজশাহী সিল্ক: রাজশাহীর সিল্ক ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল রয়েছে। এপার বাংলা ওপার বাংলা-দুই বাংলাতেই এ সিল্কের বেশ কদর রয়েছে। ২০১৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাজশাহী সিল্ককে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করে বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড রাজশাহী। ২০২২ সালের ২৬ এপ্রিল জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পায় রাজশাহী সিল্ক।
বগুড়ার দই: ২০১৮ সালে ১ জানুয়ারি বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি বগুড়া জেলা শাখা ‘বগুড়ার দই’ জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির আবেদন করে। ২০২৩ সালের ৫ জুলাই বগুড়ার দই জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাই। বগুড়া জেলার নাম শুনলে দইয়ের কথা মনে পড়ে যায়। ঐতিহ্যবাহী এ খাবার দেশব্যাপী কদর রয়েছে।
কাঁচাগোল্লা: মূলত ছানার সঙ্গে পরিমাণমতো চিনিযুক্ত করেই এই কাঁচাগোল্লা তৈরি করা হয়। চলতি বছরের ৮ আগস্ট জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পায় নাটোরের কাঁচাগোল্লা। এর আগে ২০২৩ সালের ৩০ মার্চ নাটোরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ জিআই পণ্য হিসেবে নাটোরের কাঁচাগোল্লার স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেছিলেন।