১ কোটি ৬৪ লাখ ইঁদুর মেরে ৪৯৪ কোটি টাকার ফসল রক্ষা

নিজস্ব প্রতিবেদক: ২০২২ সালে ১ কোটি ৬৪ লাখ ৫৮ হাজার ৯২৯টি ইঁদুর মেরে প্রায় ১ লাখ ২৩ হাজার ৪৪২ মেট্রিকটন ফসল রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। এই পরিমাণ ফসলের বাজারমূল্য প্রায় ৪৯৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।

এর আগে ২০২১ সালে ১ কোটি ৩৪ লাখ ৭৬ হাজার ৫১৮টি ইঁদুর নিধন করে ১ লাখ ১ হাজার মেট্রিকটন ফসল বাঁচানো সম্ভব হয়।

আজ সোমবার রাজধানীর খামারবাড়িতে জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান-২০২৩ এর উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। ফসল রক্ষায় বাস্তুতন্ত্রের কোনো ধরনের ক্ষতি না করে ইঁদুর প্রতিরোধের জন্য ১৯৮৩ সাল থেকে এই কর্মসূচি পরিচালনা করে আসছে অধিদপ্তর।

এই কর্মসূচির আওতায় মূলত কৃষকরাই ইঁদুর নিধন করে থাকেন। তাদের মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক ইঁদুর নিধনকারীদের পুরস্কৃত করা হয়। হিসাব রাখার জন্য তারা নিধনকৃত ইঁদুরের লেজ জমা দেন। এক্ষেত্রে একমাত্র দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থা হিসেবে কাজ করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিভাগ। এ বছর জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযানের প্রতিপাদ্য ‘ইঁদুরের দিন হবে শেষ, গড়ব সোনার বাংলাদেশ’।

মানুষের সঙ্গে ইঁদুরের লড়াইয়ের ইতিহাস খুব পুরোনো। একবার ৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়ে পরের দুই শতাব্দী ধরে চলা জাস্টিনিয়ান প্লেগ মহামারিতে সারা পৃথিবীর প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। তখনকার হিসেবে এটি ছিল পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ। এই প্লেগের মূল বাহক ছিল ইঁদুর।

আবার ১৩৫০ সালে দ্য ব্ল্যাক ডেথ নামে খ্যাতি পাওয়া বুবোনিক প্লেগে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের মৃত্যু হয়েছিল। তাই সবসময়ই ইঁদুর থেকে রক্ষা পেতে সম্ভাব্য সব ধরনের প্রতিরোধ জারি রাখার চেষ্টা করে এসেছে মানুষ। অথচ মজার বিষয় হচ্ছে ইঁদুর ও মানুষের অবস্থান এখনো অনেক কাছাকাছি।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে প্রতিবছর দেশে ইঁদুরের কারণে গড়ে ৫০০ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়। তবে সরকারি-বেসরকারি খাদ্যগুদাম, পাউরুটি ও বিস্কুট তৈরির কারখানা, হোটেল-রেস্তোরাঁ, পাইকারি ও খুচরা পণ্য বিক্রির দোকানে বিপুল পরিমাণে খাদ্য ইঁদুর নষ্ট করলেও তার কোনো হিসাব সরকারিভাবে করা হয় না।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর ২০১০ সালে বিশ্বব্যাপী ইঁদুরের উৎপাত নিয়ে করা এক গবেষণার তথ্য অনুসারে, বিশ্বের অন্যতম ইঁদুর উপদ্রুত এবং বংশবিস্তারকারী এলাকা হচ্ছে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা। যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এখানকার উপকূলীয় লোনা ও মিঠা পানির মিশ্রণের এলাকাগুলো ইঁদুরের বংশবিস্তারের জন্য বেশ অনুকূল। ফসলের মাঠ ছাড়াও এই অববাহিকায় অবস্থিত হাট-বাজার ও শিল্পাঞ্চলগুলোতেও ইঁদুরের দাপট বেশি।

আবার আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র (ইরি) ইঁদুরের উৎপাতের কারণে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ১১টি দেশকে চিহ্নিত করেছে। তারা বলছে, বাংলাদেশের অর্ধেক জমির ফসল ইঁদুরের আক্রমণের শিকার হয়। ইরির আরেকটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রায় ১০ শতাংশ ধান-গম ইঁদুর খেয়ে ফেলে ও নষ্ট করে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিভাগের পরিচালক মো. ফরিদুল হাসান জানাচ্ছেন, বাংলাদেশে ইঁদুরের আক্রমনে বছরে উৎপাদিত আমন ধানের শতকরা ৫ থেকে ৭ ভাগ, গমের ৪ থেকে ১২ ভাগ, গোল আলুর ৫ থেকে ৭ ভাগ ও আনারসের ৬ থেকে ৯ ভাগ নষ্ট করে। সবমিলিয়ে ইঁদুর গড়ে মাঠ ফসলের ৫ থেকে ৭ শতাংশ ও গুদামজাত শস্যের ৩ থেকে ৫ শতাংশের ক্ষতি করে। নষ্ট করে ৭ থেকে ১০ ভাগ সেচনালা।

ফরিদুল হাসানের ভাষ্য, এসব কারণে ধান উৎপাদনকারী প্রতিটি দেশে কৃষক, চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা ইঁদুরকে গুরুত্বপূর্ণ বালাই হিসেবে বিবেচনা করেন।

আবার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাসের একটি লেখা থেকে জানা যায়, ইঁদুর মুরগির খামারে গর্ত করে, খাবার-ডিম ও বাচ্চা খেয়ে বছরে খামারপ্রতি প্রায় ১৮ হাজার টাকা ক্ষতি করে।

এদিকে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ইরি) ২০১৩ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, এশিয়ায় ইঁদুর বছরে যে পরিমাণ ধান-চাল খেয়ে নষ্ট করে, তা ১৮ কোটি মানুষের এক বছরের খাবারের সমান। আর শুধু বাংলাদেশে ইঁদুর ৫০ থেকে ৫৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবার নষ্ট করে।